পূর্বরাগ

একপেট ভাত খেয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে জানালা দিয়ে ভেসে আসা শীতের দুপুরের নরম রোদ্দুরে ঢুলুঢুলু চোখে, পেটে খেয়ে মনের আরামকে একটু অনুভব করার চেষ্টা করছিল গদানন। বন্ধ চোখেই মনের আন্দাজে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ও তর্জনীর চিমটেতে উপরের ডান মাড়িতে সদ্য মাথা তোলা আক্কেল দাঁতের গোড়ায় আটকানো পুঁটি মাছের মাথা থেকে ভাঙা ছোট্ট কাটাটা সে একই সাথে বের করার একটা ঢিলেঢালা চেষ্টাও চালাচ্ছিল। এরই মধ্যে ডানপাশে বসা গৌরাঙ্গের বামকুনইয়ের একখানা মোক্ষম খোঁচা গদানুনের ডান পাঁজরে লাগতেই তার সব শান্তির পিন্ডি চটকে গেল।

— এই গদা, সোজা হয়ে দাঁড়া! অলীক স্যার এসেছেন।
গৌরাঙ্গ ফিসফিসিয়ে গদাননকে বলল।
মফস্বলের স্কুল। ক্লাস শুরুর ঘন্টা পড়তেই টিফিন পিরিয়ডের শিয়াল কুকুরের মত চিৎকার চেঁচামেচি শেষ হয়ে উড়ন্ত প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সব ভোমরাদের মতো যে গুঞ্জন চলছিল সেটাও এবার নিশ্চুপ হয়ে গেল। এক পাল্লা ভাঙা দরজা পেরিয়ে অলীক স্যার ক্লাসরুমে এসে টেবিলের সামনে দিয়ে গিয়ে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ক্লাসের সবাই জানে এবার তিনি খোলা জানালা দিয়ে আকাশটাকে এক মনে মিনিট কয়েক দেখবেন। তারপর ফিরে এসে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনের চেয়ারটাতে বসে পড়ানো শুরু করবেন। এটা অলীক স্যারের নিত্যদিনের রুটিন। এগারো ক্লাসের সব ছেলেরা বহুদিন ধরেই এতে অভ্যস্ত।

অলীক স্যার ভীষণ রাগী। তবে কোন মানুষ কি আর পুরোটাই দোষে ভরা হয় কখনো? মানুষ মাত্রই কিছু না কিছু মান আর হুশ তো থাকবেই রে বাবা! তাই না সে মানুষ? সেই নিয়মে অলীক স্যারের অনলের মত রাগ যদি দোষ হয় তবে গুণের কথাটাও বলে নেওয়া ভাল। ক্লাসে এসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে খানিক চেয়ে যদি অলীক স্যারের মনে একবার ভাবের সঞ্চার হয় তবে দুনিয়া রসাতলে গেলেও অলীক স্যারের মতো ভাল মানুষ শিক্ষক এই স্কুলে আর নেই। স্যার নিজের ভাবে একটানা তাঁর বাংলা ভাষার ক্লাস নিয়ে যাবেন, শুধু তাঁকে বিরক্ত না করলেই হল। ক্লাসে গন্ডগোল না করলে কে কি করল আর না করল তা আর অলীক স্যারের গ্রাহ্য করার আওতায় পড়ে না। টিফিনে বড় কৌটো থেকে পেট ভরা ভাত খেয়ে গদানন ক্লাসের শেষ বেঞ্চে বসে বরাবরই ঘুমের রাজ্যের সীমানায় ঘুরে বেড়ায়। তাই অলীক স্যার আর এই দুজনের স্বার্থ বা ভাললাগা কখনো একে অন্যের বেড়ে ওঠায় এখনও বাধা প্রদান করেনি।

ডান পাঁজরে গৌরাঙ্গের জোরালো খোঁচা খেয়ে গদানন কোনরকমে উঠে দাঁড়ালো কিন্তু পুরো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারল না। ঘুমটা এখনো যেন চোখের নিচের পাতায় এসে দোল খাচ্ছে। বরাবরের মতো এই দোল খাওয়া থামিয়ে এই ঘুম যে এখন কোনমতেই চোখের পাতা ছেড়ে নিচে ছিঁড়ে পড়বে না তা গদানন ভালই টের পাচ্ছিল। এখন শুধু একটাই অপেক্ষা, কখন অলীক স্যার পড়ানো শুরু করবেন। গদানন জানে স্যারের পড়ানো শুরু হলেই ওর ঘুমটাও একটা সামারসল্ট দিয়ে উপরে চোখের পাতাকে আঁকড়ে ধরে ঘুম পাড়ানির দেশে ঠিক তাকে নিয়ে পৌঁছে যাবে।

অলীক স্যার বেশ রোগা আর খানিকটা লম্বা। বরাবরই ধুতি-পাঞ্জাবি পরে স্কুলে আসেন। সাদা ধবধবে পাট ভাঙ্গা ধুতিতে দেখতে বেশ লাগে মানুষটাকে। সমস্যা শুধু স্যারের মনের ভাব আর রাগী মেজাজটাকে নিয়ে। এ দুটো একসাথে চলতে একেবারেই শেখেনি। তবে একটা ব্যাপার এই বাংলা ক্লাসে বরাবর একই রকম চলছে। সেটা হল, যবে থেকে অলীক স্যার ক্লাসে কবিতা পড়াচ্ছেন তবে থেকেই তিনি কবিতাগুলোর ভাব বিশ্লেষণ নিয়ে অনুভূতির মহাসমুদ্রে সপ্তডিঙ্গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। আর যতই পড়াচ্ছেন ততই সে ডিঙ্গা যেন তরতরিয়ে এগিয়ে চলেছে, থামতেই চাইছে না।

‘রাধার কি হইলো অন্তরে ব্যথা’।
অলীক স্যার রাধাকৃষ্ণের প্রেম জীবনের প্রথম পর্যায়ে পূর্বরাগের শুরুর লাইন গুলো বলতে শুরু করলেন। ক্লাস যথারীতি নিশ্চুপ হয়ে রইল। গদাননের উপর ও নিচের চোখের পাতা একে অন্যের হাত ধরাধরি করে নিল। কিছুতেই আর তাদের প্রেমকে আলাদা করে রাখা গেল না। গদাননের মনে তখন খালি ওর মায়ের মুখখানা আর তাঁর ভাসা ভাসা কথা তিরতির করে কেঁপে কেঁপে উঠছিল-
— ওরে গদা, সারাদিন খাচ্ছিস তো, কিন্তু ইস্কুলের টিফিনেও এত ভাত আর খাস না রে বাবা !

বেশ একখানা শিরশির হাওয়া আসছিল জানলা থেকে। গদানন সেই হাওয়ায় এক পেট ভাতের উপরে ভর করে ঘুমের রাজ্যে দিব্যি ভেসে ভেসে উড়ছিল। গদাননের পাশ দিয়ে নরম নরম ফোলা ফোলা হাওয়াই মিঠাইয়ের মত মেঘগুলো সাঁতার দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। অনেক নিচে সবুজ পৃথিবী। সেখানে ধানের ক্ষেতে সোনা রঙ ধরেছে। আর ক’দিন পরেই ধান পাকবে। পাকা ধান কাটা হবে। ধান থেকে চাল বেরোবে। চাল ফুটে ভাত। সেই গরম ভাতের থালা নিয়ে গদানন তৃপ্তি করে বসে খাবে। দিব্যি চলছিল স্বপ্ন। হঠাৎ কোত্থেকে একটা দাঁড় কাক উড়ে এসে বিচ্ছিরি জোরে ঠকাশ করে গদাননের মাথায় এক রাম ঠোক্কর মেরে বলল,
— হতচ্ছাড়া, নাক ডাকিয়ে ঘুমানো হচ্ছে?

অলীক স্যারের তেমন কোন দোষ ছিল না। স্যার তো ভাবের ঘোরে দিব্যি পড়াচ্ছিলেন । পূর্ব রাগের প্রেম স্যারের কথায় ঝরে ঝরে পড়ছিল আর ক্লাসরুমে বর্ষার ময়ূরের মত পেখম তুলে নাচছিল। সব নাচানাচির বারোটা বাজিয়ে দিল গদাননের নাকের ওই দশাসই গর্জন। একটানা কবিতাটা পড়ানো স্যারের শেষ হয়েছিল কিন্তু এমন ভাবাবেগকে কি সহজে ছেড়ে দেওয়া যায়? তাই অলীক স্যার কোনদিনও যা করেননি আজ সেটাই করে ফেললেন। কবিতার অনুশীলনীর প্রশ্নোত্তরে মন দিলেন। তিনি পূর্বরাগের সংজ্ঞা লিখতে বলে মুখে মুখে নিজেই উত্তর বলে চললেন,
— বয়ঃসন্ধির সদাচঞ্চল রোমাঞ্চ রঙিন মুহূর্তে সশরীরে সাক্ষাতের পূর্বে নায়ক নায়িকার হৃদয় বেলায় আকুল প্রেমের যে ঢেউ উত্তাল হয়ে ভেঙে পড়ে তাকে পূর্বরাগ বলে।

সারা ক্লাস নিস্তব্ধ। স্যার গভীর প্রশান্তিতে স্মিত মুখে চোখ তুলে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
— কি বুঝলে তোমরা?
প্রবল উৎসাহে উত্তর এল,
— ফো-র-র-র-ঘোৎ ।
অলীক স্যার বিস্মিত হয়ে শব্দগুচ্ছের রূপভান্ডার ছেড়ে তার উৎস সন্ধানে এদিকে ওদিকে বড় বড় চোখে চাইলেন আর বললেন,
— কে উত্তর দিলি রে?
— ঘো-র-র-র-ফোঁৎ।
অল্প রূপ পাল্টে শব্দ ফেরত এল ক্লাসের একদম পিছনের সারি থেকে।
লম্বা লম্বা পা ফেলে খুব দ্রুত অলীক স্যার ক্লাসের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ালেন। জানালার পাশে শেষ বেঞ্চে মাথা রেখে মাঝ দুপুরের নরম রোদে গদানন তখন নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে।

মেঘের পাশে ভাসতে ভাসতে মাথায় দাঁড় কাকের ঠোক্কর খেয়ে গদানন ঘুম জড়ানো গলায় বলল,
— ঠোকরাস না রে দাঁড়ু। মনে রাগ জমছে কিন্তু ।

এমন জবাবে অলীক স্যার প্রচন্ড রেগে গর্জন করে গদাননের মাথায় আরও একটা প্রকাণ্ড গাট্টা মারলেন,
— পূর্বরাগ?
— ওরে বাবা!
গদাননের ঘুম ছুটল আর সে লাফিয়ে উঠল। তারপর চোখ খুলতেই দেখল, ভীষণ রাগি চোখে কটমট করে অলীক স্যার তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

উত্তেজিত অলীক স্যার চেঁচিয়ে উঠলেন,
— ঘুমানো হচ্ছে হতচ্ছাড়া? আমি এত যত্ন করে পড়াচ্ছি আর তুই ঘুমাচ্ছিস? বল কি পড়াচ্ছিলাম?
ঘুমন্ত গদানন জেগে ওঠে ঘাবড়ে গিয়ে বলল,
— বাংলা, স্যার!
স্যারের মেজাজ গেল তুমুল চটকে। দাঁত খিঁচিয়ে তিনি বললেন,
— বাংলা ক্লাসে কি আমি উর্দু পড়াবো গাধা? বল হতভাগা, বাংলার কি পড়াচ্ছিলাম?

এইটুকু সময়ের মধ্যেই গদাননের ঘুম পুরোপুরি ছুটেছে। শুধু গদানন কেন, এই ক্লাসের কেউ কখনো এত রাগতে দেখেনি অলীক স্যারকে। ফর্সা মানুষটার মুখটায় রাগের লাল আভা এসে হাজির হয়েছে ততক্ষণে। গদাননকে বাঁচাতে পাশে বসা গৌরাঙ্গ বিড়বিড়িয়ে বলল,
— চন্ডীদাস। বৈষ্ণব পদাবলী।
ক্লাসের স্বার্থপর নিস্তরঙ্গ বাতাস কিছু কথা শুষে নিল আর সেই সাথে গদাননের কানও বিশ্বাসঘাতকতা করে বসলো । গৌরাঙ্গর বিড়বিড়ানি শুনে গদানন যা বুঝলো, কিছু না ভেবেই ভয়ে ভয়ে তাই বলে দিল,
— চন্ডীদা বিষ্ণুর পাঁঠাবলী।

অলীক স্যার হাঁ করে গদাননের দিকে চেয়ে রইলেন। এত আবেগ নিয়ে এত কষ্টে পড়ানো পদাবলীকে পাঁঠাবলী বলে দিল এই ছেলেটা? এর থেকে বিস্ময়ের আর কিছু এ পৃথিবীতে আপাতত অলীক স্যারের কাছে ছিল না। খানিকটা ধাতস্থ হয়ে এবার স্যার গদাননকে খেঁকিয়ে উঠলেন,
— উল্লুক, চন্ডীদা তোর মোড়ের মাথায় পাঁঠার দোকান দেয়? আপদ কোথাকার। তোর নাম কি রে?
— গদানন, স্যার।
গদানন ভয়ে ভয়ে উত্তর দিল।

অলীক স্যার ক্লাস টিচার নন। সব ছেলেপুলের নাম মনে রাখা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
— ইস কি নামের ছিরি! একেবারে হিন্দুস্তান-পাকিস্তানের দশা। গদানন! গদাধর শুনেছি, দশানন শুনেছি। এই গদানন কি বস্তু রে বাবা? গদা হাতে রাবণ?

নিজের ভাবের বাংলা ভুলে অলীক স্যার ক্লাসের ছেলেদের বাংলায় নেমে এলেন।
— মূর্ধন্য নয়, দন্ত ‘ন’ স্যার।
গদানন মিন মিন করে নিজের নামের আব্রু রক্ষার চেষ্টা করল।
— এক থাপ্পড় মেরে সব দন্ত গুলো খুলে দেব হতচ্ছাড়া।

অলীক স্যারের কথায় গদানন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। সেও জানে না গদানন মানে কি। গদার মত চোখ? কিন্তু চোখ কি আর গদার মত হয়, নাকি গদার কোন চোখ থাকে? তার আর কি করার আছে? বাপ মা আদর করে নামটা রেখেছে। এখন কেন রেখেছে তা বোঝার আগেই তো নামটা নিজের অস্তিত্ব বুঝে নিয়েছিল। তার আর কিসের দোষ?

— তোর নাম পাঁঠানন দেওয়া উচিত ছিল। হতভাগা দিল আমার মনের ভাবের বারোটা বাজিয়ে।
অলীক স্যার তেমনি ভীষণ রেগে বলে উঠলেন।
— বল দিকিনি, পূর্বরাগ ছাড়া আর কি রাগ হয়? বলতে না পারলেই বের করে দেব ক্লাস থেকে।

গদানন একটু ভাবলো। এই ভর পেট খেয়ে ক্লাসের বাইরে এখন দাঁড়ানো খুবই কষ্টের ব্যাপার। তাই সে একটু ভেবেই কাঁচুমাচু মুখে বলল,
— পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ রাগ।

অলীক স্যারের মুখের হাঁ আরও তিন আঙ্গুল বেড়ে গেল গদাননের এই তিন রকম রাগের নাম শুনে। এসবই স্যারের অজানা ছিল। তিনি শুধু জানতেন, প্রেমের সাক্ষাতের পূর্বে হল পূর্বরাগ আর সাক্ষাৎ পরবর্তী প্রেমের রাগকে বলে অনুরাগ।

অলীক স্যারের স্থির মূর্তি দেখে গদানন আরও একটু চেষ্টা করল রাগের সংখ্যা বাড়ানোর। তার কিছুতেই ক্লাসের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। তাই সে একটু উৎসাহেই বলল,
— বিরাগ,চিরাগ, বিতরাগ, পরাগ।

অলীক স্যার বোধহয় এই উত্তর পেয়ে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। বাংলা ভাষায় উৎসর্গীকৃত প্রাণ শিক্ষকের এমন রাগের নাম শুনে রাগ হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু অলীক স্যারের রাগও বোধহয় গদাননের জ্ঞানে দিশেহারা হয়ে চুপ করে গিয়েছিল। তিনি ধীর পায়ে হেঁটে ফিরে গেলেন নিজের চেয়ারে। তারপরে ধপ করে সেখানে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। তাঁর এত সাধের বৈষ্ণব পদাবলীর বিসর্জন যাত্রা তিনি বোধহয় দিব্যচোখে প্রত্যক্ষ করছিলেন। শেষকালে মাথা তুলে তিনি ক্লাসের পিছনের সারির দিকে আবার তাকালেন ও ইশারায় গদাননকে তাঁর সামনে আসতে বললেন। গদানন তার গদার মত চেহারা নিয়ে ভয়ে ভয়ে বাংলা স্যারের সামনে এসে দাঁড়ালো। অলীক স্যার জিজ্ঞাসা করলেন,
–চন্ডীদাস কে?

চন্ডীদাস যে পাড়ার মোড়ের মাথার পাঁঠা কাটার লোক নন, অন্য কোন গুণী মানুষ হবেন এটা গদানন বুঝতে পেরেছিল। তাছাড়া গৌরাঙ্গ বলেছিল চন্ডীদা। তার পদবী বলেনি। চন্ডীদার পদবী দাস না হয়ে অন্য কিছু তো হতেই পারে। তাহলে সে লোকটা নির্ঘাত আলাদা। এসব চিন্তা করে গদানন চুপচাপ রইল।
তাকে নির্বাক থাকতে দেখে এবারে অলীক স্যার আবার জিজ্ঞাসা করলেন,
— বৈষ্ণব কি?

পাশের বাড়ির রাধার বাবা যে গলায় তুলসীর মালা নিয়ে আমিষ না ছুঁয়ে বৈষ্ণব হয়েছেন গেল বছর, সেটা গদানন জানতো। কিন্তু গলায় তুলসীর মালা পরাকে বৈষ্ণব বলে নাকি আমিষ না খাওয়াকে – তা নিয়ে গদানন এবারে চূড়ান্ত বিভ্রান্তিতে পড়ল। পর্বত আরোহী চূড়ার অন্তে পৌঁছলে শত কষ্টেও পরম শান্তি লাভ করে। কিন্তু সেই মানুষেরই ধৈর্য চূড়ার অন্তে পৌঁছে কেন যে প্রশান্তির সমুদ্র না হয়ে রাগের অগ্নুৎপাত ঘটায় সেও এক ভাববার বিষয়। চূড়ান্ত ধৈর্যচ্যুতিতে অলীক স্যার চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে টেবিলে একখানা মোক্ষম চাপড় মেরে চেঁচিয়ে বললেন,
— বল গাধা, রাধা কে?

স্যারকে অমন চেঁচিয়ে লাফাতে দেখে প্রবল ঘাবড়ে গিয়ে গদানন তিন হাত পিছনে ছিটকে এল। এ উত্তরটা তার জানা। তাই সে কুঁইকুঁই করে বলল,
— রাধা বৃন্দাবন বাবুর মেয়ে। আমাদের পাশের বাড়ি থাকে। আমার থেকে দু ক্লাস নিচে পড়ে। ভোরে ফুল তোলে, গান গায়। সকালে থালা বাটি মেজে স্কুলে যায়। বিকালে উঠোন ঝাঁট দেয়, গরুর দুধ দোওয়ায়। সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালানো হয়ে গেলে পড়তে বসে । রাতে ঘুমায়। রাধা খুব ভালো মেয়ে। ক্লাসে প্রথম হয়।

সমস্ত ক্লাস নিস্তব্ধ। অলীক স্যার নির্বাক হয়ে তেমনি দাঁড়িয়ে গদাননের দিকে চেয়ে আছেন। গদাননও চুপচাপ পরিস্থিতি বোঝার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। বৈষ্ণব পদাবলী, রাধা, অলীক স্যার, গদানন- সমস্ত কাব্য বা চরিত্র এর ওর ঘাড়ে পড়ে ঘেঁটে ঘুঁটে ওলট-পালট হওয়ার দিকে এগোচ্ছিল।

আর যাই হোক না কেন অলীক স্যার তাঁর সমস্ত বাংলা শিক্ষায় চন্ডীদাসের বৈষ্ণব পদাবলীর রাধার জীবনে এত পরিশ্রমের কথা কল্পনাতেও আনতে পারেননি। শ্রীরাধা তো প্রেম সমুদ্রে ডুবে ছিল। হঠাৎ করেই অলীক স্যারের এই কিশোরী রাধার জন্য এত নাটকীয়তার মাঝেও একটা বেদনা মনের গভীরে দলা পাকিয়ে উঠতে লাগল। আহারে, বেচারী রাধা। তখন সে প্রেমের আকুতিতে কেঁদে কেঁদে মরে ছিল আর এখন মনের সাথে শরীরের খাটনির কষ্টেও নিশ্চয়ই সেই একই রকম কেঁদে কেঁদে মরছে। এইটুকু মেয়ে! পড়াশোনা করা, বাড়ির কাজ করা, গান গাওয়া, দুধ দোওয়া – আর কত পারে? বাংলা প্রবাদ প্রবচনেই তো বলে ‘যে গরু দুধ দেয় তার লাথি সহ্য করতে হয়’। তাহলে ওই দুধ দেওয়া গরুও নির্ঘাত মাঝে মধ্যে দু চার ঘা লাথিও কষিয়ে দেয় এই রাধাকে? একের পর এক ছবি অলীক স্যারের মনের পর্দায় দক্ষিণা বাতাসের মতো ছুটতে শুরু করল। তাঁর অন্তরাত্মা এই হতভাগী রাধার জন্য কেঁদে উঠল। বাইরের রাগের শক্ত আবরণ ছেড়ে অলীক স্যারের মনটা এবার ভয়ানক নরম হয়ে গলতে লাগল। কেন কে জানে তাঁর মনে হল রাধার ব্যাপারে আরো কিছু জানা প্রয়োজন। এই রাধা নামটাই তাঁর শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরায় এতদিন যে অদম্য স্নেহ, মমতা, ভালবাসা, বিরহ জাগিয়ে তুলেছিল আজ সেই নামই তাঁকে বর্তমানের কোন এক অচেনা কিশোরী রাধার প্রতি অপত্য স্নেহে আকুল করে তুলল।

গদাননও অবাক হয়ে স্যারকে দেখছিল। রাগে লাল হয়ে আসা চোখ মুখের বাংলা স্যারকে হঠাৎ করে কেমন যেন নরম-সরম, পাশের বাড়ির বৈষ্ণব বৃন্দাবন বাবুর মতো দেখাচ্ছিল। খুব যেন কাছের মানুষ। মনে হয় পাশে একটু চুপ করে বসে মনের দুটো কথা অনায়াসেই এনাকে খুলে বলা যায়। চাইলেই এই শীতের রোদ্দুরে এক থালা ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত এই মানুষটার সাথে ভাগ করে খাওয়া যায়। কেন জানিনা গদাননের মনে হল অলীক স্যার বোধহয় এবার ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলবেন। কিন্তু এমন রাগী মানুষটা বেমালুম এমন নরম হলেন কি করে সেটাই গদাননের মাথায় ঢুকছিল না। তাহলে কি পিছনের বেঞ্চে বসে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল বলেই স্যারের আত্মসম্মানে লাগল? তিনি কি ভাবছেন তিনি যথেষ্ট যত্নে ছাত্রোপযোগী, ছাত্র-মনোগ্রহী শিক্ষক আজও হতে পারেননি বলেই ছাত্ররা দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রায় ডুবতে ডুবতে নিজেদের ভবিষ্যতকেও ডুবিয়ে মারছে? অলীক স্যার কি এসবই চিন্তা করছেন এখন? নিজের অপকর্মের জন্য গদাননের হঠাৎ করে বড্ড খারাপ লাগতে শুরু করল। সে ধীরে ধীরে বলল,
— স্যার দুপুরে আমি আর ভাত খাব না। আর ঘুমাবোও না।
গদাননের কথার উত্তর না দিয়ে স্যার বললেন,
— রাধা আর কি করে?

গদানন আবার ঘাবড়ে গেল। তার মনে হল স্যার নিশ্চয়ই রাধাকে খোঁজার নাম করে তাদের বাড়িতে গিয়ে তার বাবার কাছে সব নালিশ করবেন আর গদাননের পিঠে মারের চাকা চাকা দাগ নিজে না বানিয়ে গদাননের বাবাকে দিয়ে তৈরি করাবেন। সে আগের মত কুঁইকুঁই করে তাই বলল,
— ছোট ভাইকে মানুষ করে, খানিকটা রান্না করে বৃন্দাবনবাবুকে খেতে দেয়, চুলে তেল মাখতে মাখতে স্কুলের আগে পুকুরে স্নানে ছোটে, সন্ধ্যায় চোখে সরষের তেল লাগিয়ে ঘুম তাড়ায় আর পূর্ণিমার রাতে জানালায় দাঁড়িয়ে একা একা কাঁদে।

গদাননের শেষ কয়েকটা শব্দে অলীক স্যার চমকে উঠে বললেন,
— কাঁদে কেন?
— পড়া তৈরির সময় পায় না বলে বোধহয়।
গদানন একটু ভেবে উত্তর দিল।
— পূর্ণিমার রাতে কেন?
— অন্য দিন গুলোতে অত আলো থাকে না বলে আমি বুঝতে পারিনা।
— তুই পড়া বাদ দিয়ে এসব লুকিয়ে লুকিয়ে দেখিস?
— আমি কি করব? আমাদের পাশের বাড়িটাই তো ওদের।
— তাই বলে লুকিয়ে লুকিয়ে তোকে এত কিছু দেখতে হবে বাবা গদানন?
— না মানে, আমি পড়া না বুঝলে ওই তো বুঝিয়ে দেয় তাই।
গদানন আমতা আমতা করে উত্তর দিল। অলীক স্যারের বিহবলতা এক রাধার মনের পূর্বরাগকে ছেড়ে অন্য এক রাঁধার ঊজ্জ্বল ভবিষ্যতের দীপকে নিভতে দেখতে পাচ্ছিল।

— চল, রাধার বাড়ি যাই।
অলীক স্যার গদাননের হাতটা খপ করে চেপে ধরে বললেন। গদানন এমন অভূতপূর্ব অবস্থায় পড়ে কি করবে বুঝতে পারল না। ওদিকে নাটকীয় সব পট পরিবর্তন, বাক্যালাপ ও রাগ অনুরাগের নাগরদোলায় দুলতে দুলতে ক্লাস ঘরের সমস্ত ছেলেদের দল মনে মনে তৈরি হয়ে পড়ল অলীক স্যার ও গদাননের সহযাত্রী হওয়ার আশায়। সবার মনেই একই চিন্তা ভিন্ন ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হতে লেগেছে তখন। ফল্গু নদীর জলোচ্ছ্বাস ধীরে ধীরে মাটির উপরে বইতে শুরু করেছে। সে ধারার গন্তব্য বিপরীত পথে বয়ে চলেছে এক নির্দিষ্ট উৎস সন্ধানে – ‘রাধার কি হইল অন্তরে ব্যথা ‘।

স্কুল শেষ হয়ে গেছে প্রায় আধঘন্টা হল। গদাননকে অপেক্ষায় রেখে অলীক স্যার তৈরি হয়ে নিয়েছেন। শালটা গায়ে জড়িয়ে এখন তিনি লম্বা লম্বা পা ফেলছেন। অন্য ছেলেদের সাথে নেননি তিনি। গদাননকে নিয়ে এখন তিনি এগিয়ে চলেছেন সবুজ ক্ষেতের পাশ দিয়ে, রাঙা মাটির পথ ধরে বৃন্দাবনবাবুর বাড়ির দিকে। নিজের সাইকেলটা গদানন পাশেপাশে হাঁটিয়ে নিয়ে চলেছে। সূর্যটা পশ্চিম আকাশে অনেকখানি ঢলে পড়েছে। শীতের বেলায় সূর্য তাড়াতাড়িই অস্ত যায়। একটু পরেই অন্ধকার নামবে। এখন সেদিকে আর অলীক স্যারের নজর নেই। জেনে বুঝে একটা নতুন জীবনের সূর্যকে তিনি আর অস্ত যেতে দিতে চান না।

এদিকে বৃন্দাবনবাবুর বাড়ি পৌঁছে কি হবে তাই ভেবেই গদানন আপাতত শঙ্কায় অস্থির হয়ে পড়েছিল। কিন্তু গদানন একটা বিষয় জানতো না। এ সব তার জানার কথাও নয়। এ ঘটনা আজ অনেক বছর পেরিয়ে এসেছে। সেদিন শীতের এমনই এক ধোঁয়াশা ঘেরা প্রথম সন্ধ্যায় এক সদ্য কিশোরী জীবনের ভবিষ্যৎ খুঁজতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে সমাজ-সংসারের যাঁতাকলে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। সেদিন কেউ তাকে পথ দেখায়নি। কেউ তার পাশে এসে তার কাঁধে ভরসার হাত রাখেনি। শিক্ষার আঙিনাকে বিসর্জন দেওয়ার দাবিকে মানতে না পেরে সে হতভাগী কাউকে কিছু না জানিয়ে অন্তরে মরে চুপিচুপি যুদ্ধ ছেড়ে পালিয়ে ছিল। তারপর জমাট বাঁধতে থাকা সন্ধ্যায় পিছনের বাগানের বড় আমগাছটার নিচের ডালটায় সে চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল । সেদিন আমাদের এই অলীক স্যারও গদাননের মতোই জীবনের পাঠ শেখার ক্লাসে বেমালুম ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কিশোরী রাধার মনকে তিনিও বুঝতে পারেননি। পারলে হয়তো সে রাধাকেও আর হারতে হতো না। অকৃতদার এই মানুষটা তাই কোন রাধাকেই আর এখন হারতে দেখতে বা হারাতে দিতে চান না। গদাননের রাধাকেও নয়। সমস্ত রাগের অন্তরালে সেই হারিয়ে যাওয়া রাধার ‘পূর্বরাগ’ আজও অলীক স্যারের মনের আকাশে সন্ধ্যা তারার মতোই একা একা জ্বলে আছে ।

বৃন্দাবনবাবুর বাড়ির সন্ধ্যা প্রদীপের আলো স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে এবারে এক শিক্ষক ও তাঁর ছাত্রের চোখে ধরা দিল । সে আলোয় দুটি অসম বয়সী মন তখন নিজের নিজের মতো করে আলোকিত হয়ে উঠতে শুরু করেছিল।

+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0

drsajalsur

কবিতা

ঝন্টুকাকার হঠাৎ করে খেয়াল এল টাকের তলায়,গ্লাসের জলের উপরটুকু উনি …

তুমি বলেছিলে, শ্রাবণের ঝিরিঝিরি সারাদিন বৃষ্টিতে মাটির উনুনে ধোঁয়ার গন্ধ …

তোর বাড়ির লাল দেওয়ালের পাশে,পোড়া ইঁটের রঙ লাল হয় তুই …

ছোটগল্প

বিনসা রোজ বেরোয় বেশ ভোরে। ঋষপের মোনাস্ট্রির ঠিক উল্টো দিকে …

আমি গ্রামের দিকে যাই সপ্তাহান্তে। সেখানে গাছপালা খুবই বেশি। তাল, …

error: Content is protected !!
Scroll to Top