কানে শোনা

আমার অগ্রজ, বিখ্যাত স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ ইন্দ্রনীল সাহার প্রশ্ন নিয়েই আমাদের এবারের চিকিৎসা আলোচনা চালাবো বলে মনস্থির করলাম। ইন্দ্রনীলদার প্রশ্নটা আমাকে মাঝে মাঝেই শুনতে হয়, আমার চেম্বারে, রসিক রোগীদের সাথে হালকা আলোচনায় এবং অবশ্যই ইন্দ্রনীলদাদের মতো চিরযুবক চিকিৎসকদের সাথে দুটো সার্জারির মাঝে সার্জনস রুমে ‘দূর্দান্ত, রসের’ আড্ডা মারতে মারতে।

প্রশ্ন : ডাক্তারবাবু, বউ প্রশ্ন করলে কানে শুনতে পাই না! কেন এমন হয়? এর সমাধান কী জানাবেন?
সম্ভাব্য উত্তর : চিকিৎসাবিজ্ঞান সদা পরিবর্তনশীল। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরাও সদা বিভ্রান্ত। আজকে একদল যদি বলেন, এটা ঠিক, তো কালকে অন্যদল বলবেন, না ওটা ভুল। অন্য বিভাগের চিকিৎসকরা কী গবেষণায় মেতে আছেন তা আমার জানার কথা নয়, কিন্তু আমার বিভাগে যাঁরা ‘বউ প্রশ্ন করলে কানে শুনতে পাইনা কেন’ – এই নিয়ে গবেষণা করছেন, তাঁরা নিজেদের ভিতরের ‘ঠিক -ভুলের’ দ্বন্দ্ব স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজেরাই মিটিয়ে নিয়েছেন। এই ‘অপূর্ব’ মিল-তালের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, ‘হ্যাঁ’ -এর দলের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ছিলেন বিবাহিত, আর ‘না’ -এর দলে অবিবাহিত। নিজেদের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অতিরিক্ত পরিশ্রম না করে ‘হ্যাঁ’ -এর দলের বিজ্ঞানীরা ‘না’ -এর দলের অবিবাহিত বিজ্ঞানীদের বুদ্ধি করে শুধু বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিয়েছেন। আর এইটুকু কাজ করতেই দেখা গিয়েছে, এরা কেউই আর ‘বউ প্রশ্ন করলে কানে শুনতে পাইনা’ নিয়ে অহেতুক নিজেদের মধ্যে যেমন তর্ক করছেন না, তেমনি তার কারণ খোঁজার দিকে বা তার সমাধানের বের করার দিকে তেমন নজর আর দিচ্ছেন না। তার বদলে আমরা যেমন সার্জনস রুমে আড্ডা দিই, তাঁরাও তেমনই কর্মস্থলে নিজেদের মধ্যে রসের আড্ডায় মেতেছেন।
আপাতত এর বেশি খবর আমার কাছে নেই। অতিরিক্ত কিছু মতবাদ উদ্ভাবন হলেই আমি নিশ্চিত ভাবেই আপনাদের জানাবো। কথা দিচ্ছি। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই একই সমস্যায় আমিও ভুগছি এবং ব্যক্তিগতভাবে আমি চাইনা সত্ত্বর এর কোন সমাধান বের হোক।

প্রশ্ন : আর যারা বউ বাদ দিয়ে বাকিদের কথাও শুনতে পান না?
সম্ভাব্য উত্তর : এইটা বরং আলোচনার একটা বিষয়। এটারই বরং উত্তর দিই। বোঝার সুবিধার জন্য কানে শোনার সমস্যাকে আমরা দুটো ‘গ্রুপে’ ভাগ করে নিই।
প্রথম, (১) শিশু (২) বৃদ্ধ এবং (৩) এই দুই বয়সের মাঝখানের মানুষদের কানে শোনার সমস্যা।
দ্বিতীয়, (১) নার্ভ বা স্নায়ু দুর্বলতার জন্য (২) নার্ভ বা স্নায়ু ছাড়া অন্য সমস্যার জন্য কানে শোনার সমস্যা।

প্রশ্ন : বয়সের হিসেবে মানুষদেরকে যেভাবে ভাগ করলেন, সেটা নিয়ে যদি একটু আলোচনা করা যায়, ভালো হয়।
সম্ভাব্য উত্তর : আসলে প্রথম গ্রুপের মধ্যেই দ্বিতীয় গ্রুপ লুকিয়ে আছে। অর্থাৎ কিনা কানের স্নায়ুর দুর্বলতার জন্য অথবা কানের স্নায়ু সম্পূর্ণ সুস্থ থাকা সত্বেও শোনার যে সমস্যা হয়, তা যেকোনো বয়সেই হতে পারে।
স্নায়ু নিয়ে বলতে গেলে যেটা প্রথমেই মনে রাখতে হবে তা হলো, খুব ছোট বয়সে কানের স্নায়ুর দুর্বলতার জন্য যে শোনার সমস্যা হয় তা যেমন জন্মগত (congenital, intrauterine) হতে পারে, তেমনি জন্মের অব্যাবহিত পরেই জীবাণু সংক্রমণ, জন্ডিস, নিঃশ্বাসের কষ্ট (Hypoxia) – ইত্যাদি নানা কারণের জন্যও তা হওয়া সম্ভব।
একটু বড় বয়সের বাচ্চাদের কানে শোনার স্নায়ুর দুর্বলতা সাধারণত জীবাণু ( virus- মামস , চিকেন পক্স , মিজলস ইত্যাদি অথবা bacteria-টাইফয়েড ইত্যাদি) সংক্রমণের কারণে হয়। এই ধরণের সমস্যা সাধারণভাবে হঠাৎ (sudden onset) করে শুরু হয়। শিশু চিকিৎসকের সাথে সাথে সন্তানের মা বাবার এ বিষয়ে সম্যক সচেতনতা না থাকলে বেশ কিছু ‘মূল্যবান সময় নষ্ট’ হওয়ার কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নাক-কান -গলার চিকিৎসকের পক্ষে কোনরকম সাহায্য করা এক্ষেত্রে সম্ভব হয় না কারণ শিশুদেরকে বহুক্ষেত্রেই আমরা বেশ কিছুদিন পরে পরীক্ষা করে দেখার জন্য কাছে পাই।
একই সাথে একথাও অনস্বীকার্য, মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় অথবা জন্মের সাথে সাথে যদি বাচ্চার কানের স্নায়ুর দুর্বলতা থেকে থাকে, তবে তা ‘মূলে প্রতিহত’ করার কোন উপায়ই আমাদের কারোর কাছে থাকে না।
বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রে কানে শোনার সমস্যা সাধারণভাবে বয়স জনিত স্নায়ু দুর্বলতা থেকেই হয় (Presbyacusis)। কিছু ক্ষেত্রে অন্তঃকর্ণের বিশেষ কিছু অসুখের জন্য দুটি কানের মধ্যে একটি কানের স্নায়ু দুর্বলতাও লক্ষ্য করা যায়। এই ধরণের শোনার সমস্যা একটু একটু করে বৃদ্ধি পায়। এই অগ্রগতি প্রতিহত করার প্রমাণিত কোন চিকিৎসা এখনও নেই।

প্রশ্ন : স্নায়ু দুর্বলতা ছাড়া আর যে যে কারণে কানে শোনার সমস্যা হয়, সেগুলো যদি একটু সহজ ভাষায় আলোচনা করা যায় তবে উপকার হয়।
সম্ভাব্য উত্তর :গঠনের বিচারে (Anatomically) কানকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। বহিঃকর্ণ (outer ear) মধ্যকর্ণ ( middle ear) ও অন্তঃকর্ণ (inner ear)।
অন্তঃকর্ণে স্নায়ু থাকে। সুতরাং তাকে আমরা এই আলোচনা থেকে বাদ দিয়ে বাকি দুটো ভাগ নিয়ে দুটো কথা বলি।
বহিঃকর্ণ যদি ঠিকমতো গঠন না হয় ( atresia – তৈরি না হওয়া, stenosis – অত্যন্ত সরু হওয়া), সেখানে যদি ময়লা (wax -খোল), ছত্রাক বা সংক্রমণের জন্য পুঁজ জমে অথবা হাড়ের উপবৃদ্ধি ( Osteoma, Exostosis) হয়ে শব্দ ভিতরে প্রবেশের পথ বন্ধ হয়ে যায় তবে স্বাভাবিকভাবেই কানে শোনার ক্ষমতা কমে যায়।
মধ্যকর্ণের ক্ষেত্রে যে সমস্ত সমস্যার কারণে আমরা কানে কম শুনি সেগুলো হলো,
১) কানের পর্দায় (Tympanic Membrane) ছিদ্র হয়ে যাওয়া
২) কোন কারণে পর্দার উপরে ক্যালসিয়াম জাতীয় খনিজের আস্তরণ তৈরি হওয়া (Tympanosclerosis)
৩) নাক কান যোগাযোগ রক্ষাকারী টিউব (Eustachian tube) ঠিকমতো কাজ না করায় কানের পর্দার নিজের অবস্থান থেকে সরে আসা (Retracted)
৪) পর্দার পিছনে মধ্যকর্ণে ‘জল বা শ্লেষ্মা’ জাতীয় পদার্থ জমে যাওয়া (Secretory otitis media)
৫) পর্দার পিছনে থাকা শোনার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র তিনটি হাড়ের অথবা তাদের নিজেদের মধ্যে সংযোগস্থলের গঠনগত সমস্যা ( deformity, ankylosis, fixation)

এছাড়াও আরো অনেক কারণ আছে যেখানে বহিঃকর্ণ ও মধ্যকর্ণের সমস্যার কারণে বাইরে থেকে শব্দতরঙ্গ কানের সুড়ঙ্গ, পর্দা বা শোনার হাড় হয়ে বয়ে গিয়ে স্নায়ুতে ঠিকমতো পৌঁছতে পারেনা এবং আমরা কম শুনি। তবে এই সমস্ত ক্ষেত্রে বধিরতা কখনোই ‘সম্পূর্ণ’ (complete) হয় না, আংশিক (partial) হয়।

আজ এই পর্যন্তই থাক। পরে যতটুকু সহজ ভাবে সম্ভব কানে শোনার সমস্যা প্রতিহত করা (prevention) অথবা তাদের সম্ভাব্য সমাধানের বিষয়ে না হয় আলোচনা করা যাবে।

+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0

drsajalsur

কবিতা

ঝন্টুকাকার হঠাৎ করে খেয়াল এল টাকের তলায়,গ্লাসের জলের উপরটুকু উনি …

তুমি বলেছিলে, শ্রাবণের ঝিরিঝিরি সারাদিন বৃষ্টিতে মাটির উনুনে ধোঁয়ার গন্ধ …

তোর বাড়ির লাল দেওয়ালের পাশে,পোড়া ইঁটের রঙ লাল হয় তুই …

ছোটগল্প

বিনসা রোজ বেরোয় বেশ ভোরে। ঋষপের মোনাস্ট্রির ঠিক উল্টো দিকে …

একপেট ভাত খেয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে জানালা দিয়ে ভেসে …

আমি গ্রামের দিকে যাই সপ্তাহান্তে। সেখানে গাছপালা খুবই বেশি। তাল, …

error: Content is protected !!
Scroll to Top