গল্প

বিনসা

বিনসা রোজ বেরোয় বেশ ভোরে। ঋষপের মোনাস্ট্রির ঠিক উল্টো দিকে , পিচ্ ঢালা রাস্তার পাশে যেখানে বাঁশ আর কাঠের দেওয়াল মিলেমিশে আজও থুকপার দোকানটার আব্রু বাঁচিয়ে রেখে চলেছে, যে দোকানে সূর্য ডোবার আগেই একবার চাইলেই রকসি বা টংবা নেপালি মদ হাসি মুখে হাজির হয়, তার ঠিক পিছনের ছোট্ট ঘরটাতে বিনসা আছে জন্মের পর থেকেই। চিরতরে হারিয়ে যাবার আগে একদিন এ ঘরে বিনসার মা বাবাও ছিল। তারপরে একা বিনসা। বিয়ের পিঁড়িতে বসা আর হয়নি ওর। ওসবের অনেক আগেই শিয়ালের দাঁত কামড় বসিয়ে গিয়েছে অপরিপক্ক মনের গভীরে। বিনসা আর বিয়ে করেনি ঘেন্নায় । নেপালি ভাষায় বিনসা মানে ‘ভয়হীন নারী’। যে নারীর মনে সাহসের আগুন জ্বলে আছে সেই ‘বিনসা’। জীবনযুদ্ধে টিঁকে থাকার তাগিদে, কাজের খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে বিনসার কাঠ কুড়ানোর শুরু ‘কিশোরীর ঘুঙুর’ পায়ে পরার আগে থেকে। দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে এসেছে এলোমেলো সময়। শেষমেষ ঋষপের আকাশ ছোঁয়া গাছেদের তলায় তলায় ঘুরে কাঠ জোগাড়ের কাজ আর ছাড়েনি বিনসা। দিনের প্রথম সময়টা পাইনের তলায় দিব্যি কেটে যায়। এতে রোজগার হয়তো খুব বেশি হয় না, কিন্তু এর বেশি তার আর প্রয়োজনই বা কি? যদিও বুনো শিয়ালের দেখা পাহাড়ের বনেও মেলে কখনো কখনো, কিন্তু বিনসার কোমরে গোঁজা ছুরিকে সব শিয়ালরাই ভয় পায়। নেপালি ভাষায় বিনসা মানে ‘ভয়হীন নারী’ এই শেষ বছর সাতেক বেশ নিশ্চিন্ত আছে বিনসা। কাঞ্চা বড় হয়েছে তার কোলের গরমেই। সে গরমে এতটাই ভালোবাসা লেগেছিল যে কাঞ্চা একটু বড় হতেই একাকী শীতের রাতেও পোষ্যই বিনসার মনে সাহসের উত্তাপ জুগিয়ে গেছে ক্রমাগত। কিছু জানোয়ার গরমের লোভে ভরা কোল খালি করে নিয়ে যায় বলে কাগজের পাতায় খবর হয় বটে কিন্তু সে সব শোনা ঘটনা আজ আর বিনসাকে বিচলিত করে না। কাঞ্চা পাহারায় থাকে পুরোটা সময়। ছায়ার মতো। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলে বিনসা বাড়ি ফেরে। টুকরো কাঠের বোঝা বিকেলে ওজনদরে বিক্রি হয়ে যায় মহাজনের আড়তে। সামান্য টাকা কিন্তু তাতেই দিব্যি চলে যায় বিনসা ও কাঞ্চার। নিজের ভালো মন্দের কৈফিয়ত বিনসা আজও কারোর কাছেই দিতে বাধ্য নয়। ঈশ্বরের, কাছেও না। কারণ একটাই। জীবনযুদ্ধের লড়াইতে বিনসা জেনেছে ঈশ্বর প্রয়োজনে স্বার্থপর হতে পারে কিন্তু কাঞ্চার ছায়ারাও কখনো অকৃতজ্ঞ হয় না। পিচ্ ঢালা ঋষপের পথে ভর দুপুরেই হঠাৎ হঠাৎ মেঘ নেমে আসে। তবুও সে মেঘের মাঝেই টুকরো রোদের মতো পথ হাঁটে কোনো কোনো নারী । এ পৃথিবীর এদিকে সেদিকে, লুকোনো কোণায় কোণায় এমনই হাজারো বিনসার গল্প সবার অলক্ষে নিজের সাহসে ফুল হয়ে ফুটে থাকে। ফুল তো ফুলই। সব ফুলের গোলাপ হবার কি সত্যিই প্রয়োজন? আমরা কেউ কেউ বরং কাঞ্চা হবারই না হয় স্বপ্ন দেখি। সেটাই বা কম কি?

বিনসা Read More »

পূর্বরাগ

একপেট ভাত খেয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে জানালা দিয়ে ভেসে আসা শীতের দুপুরের নরম রোদ্দুরে ঢুলুঢুলু চোখে, পেটে খেয়ে মনের আরামকে একটু অনুভব করার চেষ্টা করছিল গদানন। বন্ধ চোখেই মনের আন্দাজে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ও তর্জনীর চিমটেতে উপরের ডান মাড়িতে সদ্য মাথা তোলা আক্কেল দাঁতের গোড়ায় আটকানো পুঁটি মাছের মাথা থেকে ভাঙা ছোট্ট কাটাটা সে একই সাথে বের করার একটা ঢিলেঢালা চেষ্টাও চালাচ্ছিল। এরই মধ্যে ডানপাশে বসা গৌরাঙ্গের বামকুনইয়ের একখানা মোক্ষম খোঁচা গদানুনের ডান পাঁজরে লাগতেই তার সব শান্তির পিন্ডি চটকে গেল। — এই গদা, সোজা হয়ে দাঁড়া! অলীক স্যার এসেছেন।গৌরাঙ্গ ফিসফিসিয়ে গদাননকে বলল।মফস্বলের স্কুল। ক্লাস শুরুর ঘন্টা পড়তেই টিফিন পিরিয়ডের শিয়াল কুকুরের মত চিৎকার চেঁচামেচি শেষ হয়ে উড়ন্ত প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সব ভোমরাদের মতো যে গুঞ্জন চলছিল সেটাও এবার নিশ্চুপ হয়ে গেল। এক পাল্লা ভাঙা দরজা পেরিয়ে অলীক স্যার ক্লাসরুমে এসে টেবিলের সামনে দিয়ে গিয়ে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ক্লাসের সবাই জানে এবার তিনি খোলা জানালা দিয়ে আকাশটাকে এক মনে মিনিট কয়েক দেখবেন। তারপর ফিরে এসে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনের চেয়ারটাতে বসে পড়ানো শুরু করবেন। এটা অলীক স্যারের নিত্যদিনের রুটিন। এগারো ক্লাসের সব ছেলেরা বহুদিন ধরেই এতে অভ্যস্ত। অলীক স্যার ভীষণ রাগী। তবে কোন মানুষ কি আর পুরোটাই দোষে ভরা হয় কখনো? মানুষ মাত্রই কিছু না কিছু মান আর হুশ তো থাকবেই রে বাবা! তাই না সে মানুষ? সেই নিয়মে অলীক স্যারের অনলের মত রাগ যদি দোষ হয় তবে গুণের কথাটাও বলে নেওয়া ভাল। ক্লাসে এসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে খানিক চেয়ে যদি অলীক স্যারের মনে একবার ভাবের সঞ্চার হয় তবে দুনিয়া রসাতলে গেলেও অলীক স্যারের মতো ভাল মানুষ শিক্ষক এই স্কুলে আর নেই। স্যার নিজের ভাবে একটানা তাঁর বাংলা ভাষার ক্লাস নিয়ে যাবেন, শুধু তাঁকে বিরক্ত না করলেই হল। ক্লাসে গন্ডগোল না করলে কে কি করল আর না করল তা আর অলীক স্যারের গ্রাহ্য করার আওতায় পড়ে না। টিফিনে বড় কৌটো থেকে পেট ভরা ভাত খেয়ে গদানন ক্লাসের শেষ বেঞ্চে বসে বরাবরই ঘুমের রাজ্যের সীমানায় ঘুরে বেড়ায়। তাই অলীক স্যার আর এই দুজনের স্বার্থ বা ভাললাগা কখনো একে অন্যের বেড়ে ওঠায় এখনও বাধা প্রদান করেনি। ডান পাঁজরে গৌরাঙ্গের জোরালো খোঁচা খেয়ে গদানন কোনরকমে উঠে দাঁড়ালো কিন্তু পুরো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারল না। ঘুমটা এখনো যেন চোখের নিচের পাতায় এসে দোল খাচ্ছে। বরাবরের মতো এই দোল খাওয়া থামিয়ে এই ঘুম যে এখন কোনমতেই চোখের পাতা ছেড়ে নিচে ছিঁড়ে পড়বে না তা গদানন ভালই টের পাচ্ছিল। এখন শুধু একটাই অপেক্ষা, কখন অলীক স্যার পড়ানো শুরু করবেন। গদানন জানে স্যারের পড়ানো শুরু হলেই ওর ঘুমটাও একটা সামারসল্ট দিয়ে উপরে চোখের পাতাকে আঁকড়ে ধরে ঘুম পাড়ানির দেশে ঠিক তাকে নিয়ে পৌঁছে যাবে। অলীক স্যার বেশ রোগা আর খানিকটা লম্বা। বরাবরই ধুতি-পাঞ্জাবি পরে স্কুলে আসেন। সাদা ধবধবে পাট ভাঙ্গা ধুতিতে দেখতে বেশ লাগে মানুষটাকে। সমস্যা শুধু স্যারের মনের ভাব আর রাগী মেজাজটাকে নিয়ে। এ দুটো একসাথে চলতে একেবারেই শেখেনি। তবে একটা ব্যাপার এই বাংলা ক্লাসে বরাবর একই রকম চলছে। সেটা হল, যবে থেকে অলীক স্যার ক্লাসে কবিতা পড়াচ্ছেন তবে থেকেই তিনি কবিতাগুলোর ভাব বিশ্লেষণ নিয়ে অনুভূতির মহাসমুদ্রে সপ্তডিঙ্গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। আর যতই পড়াচ্ছেন ততই সে ডিঙ্গা যেন তরতরিয়ে এগিয়ে চলেছে, থামতেই চাইছে না। ‘রাধার কি হইলো অন্তরে ব্যথা’।অলীক স্যার রাধাকৃষ্ণের প্রেম জীবনের প্রথম পর্যায়ে পূর্বরাগের শুরুর লাইন গুলো বলতে শুরু করলেন। ক্লাস যথারীতি নিশ্চুপ হয়ে রইল। গদাননের উপর ও নিচের চোখের পাতা একে অন্যের হাত ধরাধরি করে নিল। কিছুতেই আর তাদের প্রেমকে আলাদা করে রাখা গেল না। গদাননের মনে তখন খালি ওর মায়ের মুখখানা আর তাঁর ভাসা ভাসা কথা তিরতির করে কেঁপে কেঁপে উঠছিল-— ওরে গদা, সারাদিন খাচ্ছিস তো, কিন্তু ইস্কুলের টিফিনেও এত ভাত আর খাস না রে বাবা ! বেশ একখানা শিরশির হাওয়া আসছিল জানলা থেকে। গদানন সেই হাওয়ায় এক পেট ভাতের উপরে ভর করে ঘুমের রাজ্যে দিব্যি ভেসে ভেসে উড়ছিল। গদাননের পাশ দিয়ে নরম নরম ফোলা ফোলা হাওয়াই মিঠাইয়ের মত মেঘগুলো সাঁতার দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। অনেক নিচে সবুজ পৃথিবী। সেখানে ধানের ক্ষেতে সোনা রঙ ধরেছে। আর ক’দিন পরেই ধান পাকবে। পাকা ধান কাটা হবে। ধান থেকে চাল বেরোবে। চাল ফুটে ভাত। সেই গরম ভাতের থালা নিয়ে গদানন তৃপ্তি করে বসে খাবে। দিব্যি চলছিল স্বপ্ন। হঠাৎ কোত্থেকে একটা দাঁড় কাক উড়ে এসে বিচ্ছিরি জোরে ঠকাশ করে গদাননের মাথায় এক রাম ঠোক্কর মেরে বলল,— হতচ্ছাড়া, নাক ডাকিয়ে ঘুমানো হচ্ছে? অলীক স্যারের তেমন কোন দোষ ছিল না। স্যার তো ভাবের ঘোরে দিব্যি পড়াচ্ছিলেন । পূর্ব রাগের প্রেম স্যারের কথায় ঝরে ঝরে পড়ছিল আর ক্লাসরুমে বর্ষার ময়ূরের মত পেখম তুলে নাচছিল। সব নাচানাচির বারোটা বাজিয়ে দিল গদাননের নাকের ওই দশাসই গর্জন। একটানা কবিতাটা পড়ানো স্যারের শেষ হয়েছিল কিন্তু এমন ভাবাবেগকে কি সহজে ছেড়ে দেওয়া যায়? তাই অলীক স্যার কোনদিনও যা করেননি আজ সেটাই করে ফেললেন। কবিতার অনুশীলনীর প্রশ্নোত্তরে মন দিলেন। তিনি পূর্বরাগের সংজ্ঞা লিখতে বলে মুখে মুখে নিজেই উত্তর বলে চললেন,— বয়ঃসন্ধির সদাচঞ্চল রোমাঞ্চ রঙিন মুহূর্তে সশরীরে সাক্ষাতের পূর্বে নায়ক নায়িকার হৃদয় বেলায় আকুল প্রেমের যে ঢেউ উত্তাল হয়ে ভেঙে পড়ে তাকে পূর্বরাগ বলে। সারা ক্লাস নিস্তব্ধ। স্যার গভীর প্রশান্তিতে স্মিত মুখে চোখ তুলে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,— কি বুঝলে তোমরা?প্রবল উৎসাহে উত্তর এল,— ফো-র-র-র-ঘোৎ ।অলীক স্যার বিস্মিত হয়ে শব্দগুচ্ছের রূপভান্ডার ছেড়ে তার উৎস সন্ধানে এদিকে ওদিকে বড় বড় চোখে চাইলেন আর বললেন,— কে উত্তর দিলি রে?— ঘো-র-র-র-ফোঁৎ।অল্প রূপ পাল্টে শব্দ ফেরত এল ক্লাসের একদম পিছনের সারি থেকে।লম্বা লম্বা পা ফেলে খুব দ্রুত অলীক স্যার ক্লাসের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ালেন। জানালার পাশে শেষ বেঞ্চে মাথা রেখে মাঝ দুপুরের নরম রোদে গদানন তখন নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। মেঘের পাশে ভাসতে ভাসতে মাথায় দাঁড় কাকের ঠোক্কর খেয়ে গদানন ঘুম জড়ানো গলায় বলল,— ঠোকরাস না রে দাঁড়ু। মনে রাগ জমছে কিন্তু । এমন জবাবে অলীক স্যার প্রচন্ড রেগে গর্জন করে গদাননের মাথায় আরও একটা প্রকাণ্ড গাট্টা মারলেন,— পূর্বরাগ?— ওরে বাবা!গদাননের ঘুম ছুটল আর সে লাফিয়ে উঠল। তারপর চোখ খুলতেই দেখল, ভীষণ রাগি চোখে কটমট করে অলীক স্যার তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। উত্তেজিত অলীক স্যার চেঁচিয়ে উঠলেন,— ঘুমানো হচ্ছে হতচ্ছাড়া? আমি এত যত্ন করে পড়াচ্ছি আর তুই ঘুমাচ্ছিস? বল কি পড়াচ্ছিলাম?ঘুমন্ত গদানন জেগে ওঠে ঘাবড়ে গিয়ে বলল,— বাংলা, স্যার!স্যারের মেজাজ গেল তুমুল চটকে। দাঁত খিঁচিয়ে তিনি বললেন,— বাংলা ক্লাসে কি আমি উর্দু পড়াবো গাধা? বল হতভাগা, বাংলার কি পড়াচ্ছিলাম? এইটুকু সময়ের মধ্যেই গদাননের ঘুম পুরোপুরি ছুটেছে। শুধু গদানন কেন, এই ক্লাসের কেউ কখনো এত রাগতে দেখেনি অলীক স্যারকে। ফর্সা মানুষটার মুখটায় রাগের লাল আভা এসে হাজির হয়েছে ততক্ষণে। গদাননকে বাঁচাতে পাশে বসা গৌরাঙ্গ বিড়বিড়িয়ে বলল,— চন্ডীদাস। বৈষ্ণব পদাবলী।ক্লাসের স্বার্থপর নিস্তরঙ্গ বাতাস কিছু

পূর্বরাগ Read More »

ঘাটতি

আমি গ্রামের দিকে যাই সপ্তাহান্তে। সেখানে গাছপালা খুবই বেশি। তাল, সুপারি আর নারকেল বাদ দিলে বাকি সব গাছে ডালপালাও মেলা। এখানকার দুচারটে পড়াশোনা করা মানুষ ছাড়া বাকিদেরও তাই বয়সের অগুন্তি ডালপালা । এত গাছগাছালি যখন তখন তাদের সাথে মানুষের গা ঘষাঘষির আন্তরিকতাও বেশি হওয়ারই কথা।একইসাথে এখানে যাহা বাহান্ন তাহাই বাহাত্তর – সবই এক।কানের রোগী। বয়স বাহান্ন । এটা কাগজে লিখেও মনটা খচখচ করছিল। আসলে সামনের ‘বৃদ্ধা’কে একটু আগে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,-বয়স কত?উনি বললেন,-আন্দাজ করে একটা দিয়ে দাও।আমি মুখ আর চেহারার দিকে আরও একবার চেয়ে বললাম,-বাহাত্তর দিই?উনি বললেন,-এত দেবে? বড্ড বেশি হচ্ছে । এট্টু কমায়ে দাও। বাহান্ন করো বাবা।গ্রামের মানুষের বয়স সময়ের কড়াইতে নিজের ইচ্ছেয় ওলোটপালোট খায়। যাহা বাহান্ন তাহাই বাহাত্তর। এখানে সবই তেলের পিঠে। ঠিকঠাক একটু উল্টেপাল্টে নিতে পারলেই সুস্বাদু । মানে মেজাজ বাহান্ন হলেও বয়স হয়তো বাহাত্তর অথবা বয়স বাহান্ন হলেও মেজাজটা উল্টো।যা হোক, বাহাত্তরের বুড়িমা বাহান্নর মেজাজে আমার সামনে কানের সমস্যা নিয়ে বসে এক বিচিত্র ফিরিস্তি দিয়ে বসলেন আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই। সেটাই এখানে বলার উদ্দেশ্য এবং বলি।উনি শুরু করলেন,-আমার সব কথা শুনতি হবে কিন্তু। অনেক চিকিৎসে করেছি কান নিয়ে কিন্তু কিছুতেই তো কেউ কিছু করতি পারল না। আমার কথা শেষ হলি তুমি আমারে বলবা কেন এমন হল। সারল না কেন আমার কান। ছাতি আর ব্যথার অসুখ ছাড়া শীতের দিনে ডাক্তারদের সামনে রোগীর চাপ হালকা হয়। রোগী লেপের গর্ত ছেড়ে ডাক্তারের ফাঁদে ফাঁসে না। শীতেই তাই চিকিৎসা সম্মেলনগুলো হয় এ দেশে। সময় থাকে বলে শীতে রোগীর সাথে গল্পও জমে বেশি।আমি পেনের ঢাকনা বন্ধ করে বললাম ,-অনেক বছর তো পড়াশোনা আর চিকিৎসা করলাম। বল তোমার কথা। চিকিৎসা গলদ কোথায় শুনে বলছি।উনি বললেন,-তাইতো খবর পেয়ে এলাম। কান চুলকানি আমার। অসহ্য চুলকানি। হাতের কাছে যা পাই তাই দিয়ে চুলকাই। কাপড়ের আঁচল পাকায়ে দিই। ‘সেফটিন’ পুরি কানে। কাগজ, পানের বোঁটা, ঝাঁটার কাঠি- সব। চুলকে চুলকেও চুলকানি কমে না। শেষে গেরামের অনেক ডাকতার দেখালাম। একজন বললো , ডাবের পানি কানের ভিতর পুরে কাত হয়ি শুয়ে থাকতি। টানা একদিন। তা আমি তিনদিন শোলাম। কিছুই হল না। একজন বলল কাঁচা হলুদ আর পানের পাতা একসাথে থেঁতো করে তার রস ওর খোলে পুরতি। সে দিয়েও কিছু হল না। রসুন তেল গরম করি দেলাম। থানকুনি আর কালমেঘ পাতা বেটে পুরিয়া মতো বানায়ে একজন পুরে দিল দুই কানের ফুটোয়। তিন দিন রাখলাম। সে সব্বনেশে চুলকানি কমলো তো নাই উল্টে আরও বেড়ি গেল। কানে দু দুটো মাদুলি লাগলাম। সুতো সমেত মাদুলি ছিঁড়ে পড়ে গেলি নাকি ওর সাথে চুলকুনিও বিদেয় নেবে। ঘোড়ার ডিম হল। একজন কান ঝাড়ায়ে বলল চন্দন লাগাতি। তা কমলাদি নিজে চন্দন বেটি কানের খোলে ফোঁটা দিল সাত দিন। শেষে আর না পেরি তোমার কথা শুনে এখেনে এলাম। শোনলাম তুমি বড় ডাক্তার। তোমারে বলতি হবে, আমি এত কষ্ট করলাম, পয়সা খরচা করি ছুটে মরলাম, আমার চুলকুনি কমলো না কেন এতে? বলতি পারলি বোঝবো তুমি চাঁদ পড়াশোনা ঠিকমতো করেছো। আমার পয়সা আর এভাবে নষ্ট কোরো না বাপ্। চাঁদ আকাশে থাকে। ভাগ্যবান শুনেছি হাতে চাঁদ পায়। কেউ আমাকে চাঁদ বলে কখনো ডাকেনি আগে। কিন্তু এখন সে ডাক শুনেও হতভম্ব আমি মুখখানা অমাবস্যার চাঁদের মতো করে আমার রোগীর দিকে চেয়ে রইলাম। আমার পড়াশোনার বড় ঘাটতিটা বাহান্ন মনের বাহাত্তরের রোগী এক পলকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল আর আমি চুপচাপ গালে হাত দিয়ে বসে থাকলাম।বিশুটাও আজকাল ফচকে হয়ে যাচ্ছে। দেখলাম সে হতচ্ছাড়া ওর স্যারের অবস্থা দেখে মুখ টিপে টিপে হাসছে। drsajalsur March 7, 2024 No Comments Nextহারানো ভালোবাসাNext

ঘাটতি Read More »

error: Content is protected !!
Scroll to Top