একপেট ভাত খেয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে জানালা দিয়ে ভেসে আসা শীতের দুপুরের নরম রোদ্দুরে ঢুলুঢুলু চোখে, পেটে খেয়ে মনের আরামকে একটু অনুভব করার চেষ্টা করছিল গদানন। বন্ধ চোখেই মনের আন্দাজে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ও তর্জনীর চিমটেতে উপরের ডান মাড়িতে সদ্য মাথা তোলা আক্কেল দাঁতের গোড়ায় আটকানো পুঁটি মাছের মাথা থেকে ভাঙা ছোট্ট কাটাটা সে একই সাথে বের করার একটা ঢিলেঢালা চেষ্টাও চালাচ্ছিল। এরই মধ্যে ডানপাশে বসা গৌরাঙ্গের বামকুনইয়ের একখানা মোক্ষম খোঁচা গদানুনের ডান পাঁজরে লাগতেই তার সব শান্তির পিন্ডি চটকে গেল। — এই গদা, সোজা হয়ে দাঁড়া! অলীক স্যার এসেছেন।গৌরাঙ্গ ফিসফিসিয়ে গদাননকে বলল।মফস্বলের স্কুল। ক্লাস শুরুর ঘন্টা পড়তেই টিফিন পিরিয়ডের শিয়াল কুকুরের মত চিৎকার চেঁচামেচি শেষ হয়ে উড়ন্ত প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সব ভোমরাদের মতো যে গুঞ্জন চলছিল সেটাও এবার নিশ্চুপ হয়ে গেল। এক পাল্লা ভাঙা দরজা পেরিয়ে অলীক স্যার ক্লাসরুমে এসে টেবিলের সামনে দিয়ে গিয়ে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ক্লাসের সবাই জানে এবার তিনি খোলা জানালা দিয়ে আকাশটাকে এক মনে মিনিট কয়েক দেখবেন। তারপর ফিরে এসে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনের চেয়ারটাতে বসে পড়ানো শুরু করবেন। এটা অলীক স্যারের নিত্যদিনের রুটিন। এগারো ক্লাসের সব ছেলেরা বহুদিন ধরেই এতে অভ্যস্ত। অলীক স্যার ভীষণ রাগী। তবে কোন মানুষ কি আর পুরোটাই দোষে ভরা হয় কখনো? মানুষ মাত্রই কিছু না কিছু মান আর হুশ তো থাকবেই রে বাবা! তাই না সে মানুষ? সেই নিয়মে অলীক স্যারের অনলের মত রাগ যদি দোষ হয় তবে গুণের কথাটাও বলে নেওয়া ভাল। ক্লাসে এসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে খানিক চেয়ে যদি অলীক স্যারের মনে একবার ভাবের সঞ্চার হয় তবে দুনিয়া রসাতলে গেলেও অলীক স্যারের মতো ভাল মানুষ শিক্ষক এই স্কুলে আর নেই। স্যার নিজের ভাবে একটানা তাঁর বাংলা ভাষার ক্লাস নিয়ে যাবেন, শুধু তাঁকে বিরক্ত না করলেই হল। ক্লাসে গন্ডগোল না করলে কে কি করল আর না করল তা আর অলীক স্যারের গ্রাহ্য করার আওতায় পড়ে না। টিফিনে বড় কৌটো থেকে পেট ভরা ভাত খেয়ে গদানন ক্লাসের শেষ বেঞ্চে বসে বরাবরই ঘুমের রাজ্যের সীমানায় ঘুরে বেড়ায়। তাই অলীক স্যার আর এই দুজনের স্বার্থ বা ভাললাগা কখনো একে অন্যের বেড়ে ওঠায় এখনও বাধা প্রদান করেনি। ডান পাঁজরে গৌরাঙ্গের জোরালো খোঁচা খেয়ে গদানন কোনরকমে উঠে দাঁড়ালো কিন্তু পুরো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারল না। ঘুমটা এখনো যেন চোখের নিচের পাতায় এসে দোল খাচ্ছে। বরাবরের মতো এই দোল খাওয়া থামিয়ে এই ঘুম যে এখন কোনমতেই চোখের পাতা ছেড়ে নিচে ছিঁড়ে পড়বে না তা গদানন ভালই টের পাচ্ছিল। এখন শুধু একটাই অপেক্ষা, কখন অলীক স্যার পড়ানো শুরু করবেন। গদানন জানে স্যারের পড়ানো শুরু হলেই ওর ঘুমটাও একটা সামারসল্ট দিয়ে উপরে চোখের পাতাকে আঁকড়ে ধরে ঘুম পাড়ানির দেশে ঠিক তাকে নিয়ে পৌঁছে যাবে। অলীক স্যার বেশ রোগা আর খানিকটা লম্বা। বরাবরই ধুতি-পাঞ্জাবি পরে স্কুলে আসেন। সাদা ধবধবে পাট ভাঙ্গা ধুতিতে দেখতে বেশ লাগে মানুষটাকে। সমস্যা শুধু স্যারের মনের ভাব আর রাগী মেজাজটাকে নিয়ে। এ দুটো একসাথে চলতে একেবারেই শেখেনি। তবে একটা ব্যাপার এই বাংলা ক্লাসে বরাবর একই রকম চলছে। সেটা হল, যবে থেকে অলীক স্যার ক্লাসে কবিতা পড়াচ্ছেন তবে থেকেই তিনি কবিতাগুলোর ভাব বিশ্লেষণ নিয়ে অনুভূতির মহাসমুদ্রে সপ্তডিঙ্গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। আর যতই পড়াচ্ছেন ততই সে ডিঙ্গা যেন তরতরিয়ে এগিয়ে চলেছে, থামতেই চাইছে না। ‘রাধার কি হইলো অন্তরে ব্যথা’।অলীক স্যার রাধাকৃষ্ণের প্রেম জীবনের প্রথম পর্যায়ে পূর্বরাগের শুরুর লাইন গুলো বলতে শুরু করলেন। ক্লাস যথারীতি নিশ্চুপ হয়ে রইল। গদাননের উপর ও নিচের চোখের পাতা একে অন্যের হাত ধরাধরি করে নিল। কিছুতেই আর তাদের প্রেমকে আলাদা করে রাখা গেল না। গদাননের মনে তখন খালি ওর মায়ের মুখখানা আর তাঁর ভাসা ভাসা কথা তিরতির করে কেঁপে কেঁপে উঠছিল-— ওরে গদা, সারাদিন খাচ্ছিস তো, কিন্তু ইস্কুলের টিফিনেও এত ভাত আর খাস না রে বাবা ! বেশ একখানা শিরশির হাওয়া আসছিল জানলা থেকে। গদানন সেই হাওয়ায় এক পেট ভাতের উপরে ভর করে ঘুমের রাজ্যে দিব্যি ভেসে ভেসে উড়ছিল। গদাননের পাশ দিয়ে নরম নরম ফোলা ফোলা হাওয়াই মিঠাইয়ের মত মেঘগুলো সাঁতার দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। অনেক নিচে সবুজ পৃথিবী। সেখানে ধানের ক্ষেতে সোনা রঙ ধরেছে। আর ক’দিন পরেই ধান পাকবে। পাকা ধান কাটা হবে। ধান থেকে চাল বেরোবে। চাল ফুটে ভাত। সেই গরম ভাতের থালা নিয়ে গদানন তৃপ্তি করে বসে খাবে। দিব্যি চলছিল স্বপ্ন। হঠাৎ কোত্থেকে একটা দাঁড় কাক উড়ে এসে বিচ্ছিরি জোরে ঠকাশ করে গদাননের মাথায় এক রাম ঠোক্কর মেরে বলল,— হতচ্ছাড়া, নাক ডাকিয়ে ঘুমানো হচ্ছে? অলীক স্যারের তেমন কোন দোষ ছিল না। স্যার তো ভাবের ঘোরে দিব্যি পড়াচ্ছিলেন । পূর্ব রাগের প্রেম স্যারের কথায় ঝরে ঝরে পড়ছিল আর ক্লাসরুমে বর্ষার ময়ূরের মত পেখম তুলে নাচছিল। সব নাচানাচির বারোটা বাজিয়ে দিল গদাননের নাকের ওই দশাসই গর্জন। একটানা কবিতাটা পড়ানো স্যারের শেষ হয়েছিল কিন্তু এমন ভাবাবেগকে কি সহজে ছেড়ে দেওয়া যায়? তাই অলীক স্যার কোনদিনও যা করেননি আজ সেটাই করে ফেললেন। কবিতার অনুশীলনীর প্রশ্নোত্তরে মন দিলেন। তিনি পূর্বরাগের সংজ্ঞা লিখতে বলে মুখে মুখে নিজেই উত্তর বলে চললেন,— বয়ঃসন্ধির সদাচঞ্চল রোমাঞ্চ রঙিন মুহূর্তে সশরীরে সাক্ষাতের পূর্বে নায়ক নায়িকার হৃদয় বেলায় আকুল প্রেমের যে ঢেউ উত্তাল হয়ে ভেঙে পড়ে তাকে পূর্বরাগ বলে। সারা ক্লাস নিস্তব্ধ। স্যার গভীর প্রশান্তিতে স্মিত মুখে চোখ তুলে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,— কি বুঝলে তোমরা?প্রবল উৎসাহে উত্তর এল,— ফো-র-র-র-ঘোৎ ।অলীক স্যার বিস্মিত হয়ে শব্দগুচ্ছের রূপভান্ডার ছেড়ে তার উৎস সন্ধানে এদিকে ওদিকে বড় বড় চোখে চাইলেন আর বললেন,— কে উত্তর দিলি রে?— ঘো-র-র-র-ফোঁৎ।অল্প রূপ পাল্টে শব্দ ফেরত এল ক্লাসের একদম পিছনের সারি থেকে।লম্বা লম্বা পা ফেলে খুব দ্রুত অলীক স্যার ক্লাসের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ালেন। জানালার পাশে শেষ বেঞ্চে মাথা রেখে মাঝ দুপুরের নরম রোদে গদানন তখন নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। মেঘের পাশে ভাসতে ভাসতে মাথায় দাঁড় কাকের ঠোক্কর খেয়ে গদানন ঘুম জড়ানো গলায় বলল,— ঠোকরাস না রে দাঁড়ু। মনে রাগ জমছে কিন্তু । এমন জবাবে অলীক স্যার প্রচন্ড রেগে গর্জন করে গদাননের মাথায় আরও একটা প্রকাণ্ড গাট্টা মারলেন,— পূর্বরাগ?— ওরে বাবা!গদাননের ঘুম ছুটল আর সে লাফিয়ে উঠল। তারপর চোখ খুলতেই দেখল, ভীষণ রাগি চোখে কটমট করে অলীক স্যার তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। উত্তেজিত অলীক স্যার চেঁচিয়ে উঠলেন,— ঘুমানো হচ্ছে হতচ্ছাড়া? আমি এত যত্ন করে পড়াচ্ছি আর তুই ঘুমাচ্ছিস? বল কি পড়াচ্ছিলাম?ঘুমন্ত গদানন জেগে ওঠে ঘাবড়ে গিয়ে বলল,— বাংলা, স্যার!স্যারের মেজাজ গেল তুমুল চটকে। দাঁত খিঁচিয়ে তিনি বললেন,— বাংলা ক্লাসে কি আমি উর্দু পড়াবো গাধা? বল হতভাগা, বাংলার কি পড়াচ্ছিলাম? এইটুকু সময়ের মধ্যেই গদাননের ঘুম পুরোপুরি ছুটেছে। শুধু গদানন কেন, এই ক্লাসের কেউ কখনো এত রাগতে দেখেনি অলীক স্যারকে। ফর্সা মানুষটার মুখটায় রাগের লাল আভা এসে হাজির হয়েছে ততক্ষণে। গদাননকে বাঁচাতে পাশে বসা গৌরাঙ্গ বিড়বিড়িয়ে বলল,— চন্ডীদাস। বৈষ্ণব পদাবলী।ক্লাসের স্বার্থপর নিস্তরঙ্গ বাতাস কিছু