সদ্যোজাত ও খুব ছোট শিশুদের শোনার সমস্যা ও তার সমাধান – কিছু পরামর্শ

একটা নির্দিষ্ট বয়সের সময়সীমায় সাধারণ ভাবে যে শোনার সমস্যা হয়, তারই চিকিৎসা সম্পর্কে আমরা এই আলোচনা ভাগ করে নিচ্ছি। আজ নবজাতক ও খুব ছোটো শিশুদের নিয়ে বলবো।

প্রশ্ন: আমার বাচ্চার বয়স ছয় মাস। বাচ্চা তো দিব্যি আছে। বুকের দুধ খাচ্ছে। শুয়ে শুয়ে নিজের মতো খেলছে। সব কিছু তাকিয়ে দেখে হাসছে। কিন্তু শিশু বিশেষজ্ঞ কেন বলছেন, কানে শোনার পরীক্ষা করিয়ে নিতে?
সম্ভাব্য উত্তর: এর দুটো উত্তর হতে পারে। প্রথমটা মায়ের দিক থেকে। দ্বিতীয়টা বাচ্চার জন্ম নেয়া ও তার পরবর্তী সময়ে বাচ্চার শারীরিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে।

প্রশ্ন : মায়ের শরীর খারাপের সাথে বাচ্চার কানে শোনার সম্পর্ক আছে?
সম্ভাব্য উত্তর : নিশ্চয়ই আছে। গর্ভাবস্থায় সন্তান যখন মায়ের পেটে থাকে তখন তো সে মায়ের শরীরেরই একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। মায়ের কোন অসুখ বিসুখ হলো অথবা মা কোন শক্ত অসুখের জন্য ওষুধপত্র খেলেন – এই দুটি ক্ষেত্রেই বাচ্চার শরীরে তার প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক। মায়ের শরীরে যদি কোন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হয়, যেমন ধরা যাক হেপাটাইটিস / জন্ডিস অথবা টাইফয়েড / টিবি, অথবা তার জন্য যদি দীর্ঘদিন ওষুধপত্র খেতে হয়, তবে সেসবের প্রভাব বাচ্চার কানের স্নায়ুর উপরেও পড়তে পারে। ফলে শোনার স্নায়ু দুর্বল হয়ে বাচ্চার জন্মের পরে কানে শোনার সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসব পরিস্থিতিতে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বা শিশু বিশেষজ্ঞরা জন্মের পরেই বাচ্চার কানে শোনার ক্ষমতা ঠিক আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখে নিতে বলেন।

প্রশ্ন : আর জন্মের সময় বা পরে বাচ্চার ক্ষেত্রে?
সম্ভাব্য উত্তর: সন্তান প্রসবের সময় যদি দীর্ঘ বিলম্ব হয় (obstructed labour), যদি প্রসবকালীন নানা সমস্যার জন্য বাচ্চার শরীরে অক্সিজেন প্রবেশ যথাযথ না হয় (hypoxia) অথবা আরও সহজ করে বললে, জন্মের সাথে সাথেই যদি বাচ্চা না কাঁদে (জীবনের প্রথম কান্না আসলে বেঁচে থাকার বার্তা – ফুসফুস হয়ে পৃথিবীর বাতাস /অক্সিজেন বুক ভরে শরীরের ভিতরে টেনে নেবার জানান দেওয়া), অথবা জন্ডিস (অতিরিক্ত) বা সেপসিস জাতীয় কোন জটিল সমস্যা তৈরি হয় তাহলে বাচ্চার দায়িত্বে থাকা চিকিৎসককে সেই সব সমস্যা মোকাবিলা করার সাথে সাথে পরবর্তীকালে বাচ্চার কানের স্নায়ুর সবলতা/ দুর্বলতা পরীক্ষা করিয়ে নেওয়ার জন্য অভিভাবকদের জানিয়ে দিতে হয়।

প্রশ্ন : তাহলে এ সবকিছুই কি ইমার্জেন্সি হিসাবে ভেবে নিয়ে করতে হবে?
সম্ভাব্য উত্তর: একদমই নয়। বাচ্চা কানে ঠিকমতো শুনছে কী শুনছে না, সেটা একদিকে যেমন খুবই গুরুত্বপূর্ণ তেমনি অন্যদিকে ইমারজেন্সিও নয়। আসলে সমস্যাটা অন্য জায়গায়।
আমাদের শরীরের কিছু প্রতিবর্ত ক্রিয়া (reflex) আছে যেগুলো একটা নির্দিষ্ট বয়সের পরে নতুন করে আর কাজ করে না। ডাক্তারি পরিভাষায় একে “নিউরাল রিফ্লেক্স” (neural reflex) বলে। এর একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।
ধরা যাক একটা গরু বা মহিষের বাচ্চা হলো। মায়ের পেট থেকে মাটিতে পড়েই প্রথমে সেই বাচ্চা কী করে? সে টলমল পায়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু বারবার পড়ে যায়। এভাবেই ক্রমাগত চেষ্টা করতে করতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বাচ্চাটি নিজের পায়ের সোজা হয়ে দাঁড়াতে শিখে যায় এবং চলতে শুরু করে।
এবার ধরা যাক তার জন্মের সাথে সাথেই যদি কোনো দড়ি দিয়ে তার চারটি পা আমরা বেঁধে রেখে দিই এবং বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে সেই বাঁধন খুলে দেওয়া হয়, তাহলে হাজার চেষ্টা করা সত্ত্বেও সেই গরু বা মহিষের বাচ্চা কিন্তু আর নিজের পায়ে খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারে না। অর্থাৎ কিনা জন্মের পরপরই যে “নিউরাল রিফ্লেক্স” পা থেকে মস্তিষ্কে গিয়ে বাচ্চাটিকে খাড়া হয়ে দাঁড়ানোর জন্য চেষ্টা করছিলো, তার ক্ষমতা একটা নির্দিষ্ট সময়ে পরেই নষ্ট হয়ে যায়। তাকে নতুন করে আর তৈরি করা যায় না।
তেমনি আমাদের কানে শোনার ক্ষেত্রে জন্মের প্রথম চার পাঁচ বছরের মধ্যে আমাদের মুখে বলা কথা বা শব্দ যদি বাচ্চার মস্তিষ্কের শোনার জন্য নির্দিষ্ট অংশে গিয়ে না পৌঁছায়, তবে সেই শব্দ বা কথার অর্থ বোঝার ক্ষমতা মস্তিষ্কে আর কখনোই তৈরি হয় না। বাচ্চার কানে শোনার ক্ষেত্রে এটাই এক ধরণের “নিউরাল রিফ্লেক্স” এবং জন্মের ওই চার পাঁচ বছরের পরে তার আর নতুন করে কাজ করার ক্ষমতা থাকেনা । আমরা যা শুনি তাই বলি। ফলে এই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাচ্চা কানে যদি একদম শুনতে না পায় তাহলে কথা বলতে শেখে না ও সারা জীবনের মতো বোবা হয়ে যায়।
এই হিসেবে দেখলে যদি চিকিৎসক বা বাড়ির লোকজন সন্দেহ করেন, বাচ্চা কানে কম শুনতে পাচ্ছে, তাহলে যত দ্রুত সম্ভব কানের স্নায়ুর কর্মক্ষমতা পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত।

প্রশ্ন : আচ্ছা, মায়ের পেটে থাকা অবস্থায় যদি কোন সমস্যা না হয় অথবা বাচ্চার জন্মও যদি সুষ্ঠুভাবে হয়, তাহলেও কি বাচ্চা কানে কম শুনতে পারে?
সম্ভাব্য উত্তর: নিশ্চয়ই পারে। বাচ্চার কানে শোনার সমস্যা তৈরি হওয়ার হাজারটা কারণ থাকতে পারে।

প্রশ্ন : তাহলে সবকিছু ঠিকঠাক চললেও বুঝবো কি করে যে আমার বাচ্চা কানে শুনতে পাচ্ছে না? কি করে বুঝবো আমার বাচ্চাকে কানে শোনার বিষয়ে নিশ্চিত হতে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে যেতে হবে নিয়ে যেতে হবে?
সম্ভাব্য উত্তর: এক্ষেত্রে কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। যেমন ধরা যাক, ঘরে জোরে রেডিও বা টিভির চললো বা কলিং বেল বাজলো, অথবা বাইরে কোন মোটরসাইকেল বা গাড়ি হর্ন দিল, অথবা বাচ্চার আড়ালে দাঁড়িয়ে কেউ বাচ্চাকে ডাকলেন অথচ উপরের কোন ক্ষেত্রেই বাচ্চা ওই শব্দের উৎসের দিকে চোখ বা মাথা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা কোনোবারেই করলো না – এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সতর্ক হতে হবে বৈকি।
তাছাড়া খুব ছোট বাচ্চা হলে (মোটামুটি তিন মাসের মধ্যে) তার আশেপাশে যদি জোরালো শব্দ করা হয়, যেমন হাতের তালাটা মেঝেতে ফেলে দেওয়া হলো, বা হঠাৎ বেশ জোরে হাততালি দেওয়া অথবা চিৎকার করা হলো – এসব ক্ষেত্রে বাচ্চার কানে শোনার সমস্যা না থাকলে সে চমকে ওঠে (Moros reflex or Startle reflex)। এতেই মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যায় আমাদের বাচ্চা কানে শুনতে পাচ্ছে।

প্রশ্ন : এসব বাচ্চাদের কানে শোনার ক্ষমতা বোঝার জন্য কোন পরীক্ষা করা হয়? বাচ্চার জন্য সেসব কি কষ্টকর?
সম্ভাব্য উত্তর: কোন পরীক্ষা কোন ক্ষেত্রে করতে হবে সেটা সাধারণভাবে আপনার নাক কান গলা চিকিৎসক আপনাকে জানিয়ে দেবেন। তবে BERA (Brain Evoked Response Audiometry) পরীক্ষাটি করার চল সবথেকে বেশি।
আপনার শিশুর জন্য এ পরীক্ষা কষ্টকর নয়। ‘ই সি জি (ECG)’ করার জন্য শরীরে যেমন দু-চারটে তার লাগিয়ে দেয়া হয়, ঠিক তেমনি শিশুর মাথায় কপালে তার (ইলেক্ট্রোড ) লাগিয়ে এই পরীক্ষা করা হয়। সেই সময় শিশুকে ঘুমাতে হয়।

প্রশ্ন : বাচ্চার কানে শোনার স্নায়ু দুর্বল হয়ে গেলে সে কি তাহলে আর কোনোভাবেই শুনতে পাবে না? কথা বলাও শিখবে না?
সম্ভাব্য উত্তর : একদমই নয়। এসব কিছুরই সমাধান এখন আছে। নির্দিষ্ট সময়ে চিকিৎসা করলে কানে শুনতে না পাওয়া প্রায় সমস্ত বাচ্চাকেই “মেইনস্ট্রিমে” নিয়ে আসা সম্ভব।
কানে শোনার সমস্যা শনাক্ত হওয়া মাত্রই বাচ্চাকে কানের মেশিন ব্যবহার করানোর প্রয়োজন হতে পারে। এছাড়াও “ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট” অপারেশনের মাধ্যমে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশে শব্দ পৌঁছে দিয়ে বাচ্চাকে এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এ অপারেশন অনেকটা আমাদের হার্টের “পেসমেকার” বসানোর মতো। তবে খুব তাড়াতাড়ি এ সমস্ত কাজ না করে ফেলতে পারলে একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে যাই করা হোক না কেন তা আর কোনো কাজে আসবে না ।
একই সাথে একটা কথা মনে রাখতে হবে, কোন বাচ্চার ক্ষেত্রে কোন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে তা কেবলমাত্র একজন অভিজ্ঞ নাক-কান-গলার চিকিৎসকই বলতে পারবেন।

প্রশ্ন : আচ্ছা এমন কী হতে পারে, যে বাচ্চা কানে ঠিকই শুনছে কিন্তু কথা বলতে পারছে না?
সম্ভাব্য উত্তর: নিশ্চয়ই হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে বাচ্চা কানে শুনছে কিন্তু ইচ্ছে করে কথা বলছে না বা কথা চেষ্টা করেও বলতে পারছে না। কিছু কিছু মানসিক বা নিউরোলজির সমস্যার কারণে (ADHD, AUTISM, CEREBRAL PALSY) বাচ্চা কানে শুনতে পেলেও কথা বলে না।
এক্ষেত্রেও একইভাবে কানের স্নায়ুর কর্মক্ষমতার ব্যাপারে আমাদের নিশ্চিত হতে হবে এবং উপযুক্ত ডিপার্টমেন্টে (Psychiatry, Neurology) বাচ্চাকে সত্ত্বর পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0

drsajalsur

কবিতা

ঝন্টুকাকার হঠাৎ করে খেয়াল এল টাকের তলায়,গ্লাসের জলের উপরটুকু উনি …

তুমি বলেছিলে, শ্রাবণের ঝিরিঝিরি সারাদিন বৃষ্টিতে মাটির উনুনে ধোঁয়ার গন্ধ …

তোর বাড়ির লাল দেওয়ালের পাশে,পোড়া ইঁটের রঙ লাল হয় তুই …

ছোটগল্প

বিনসা রোজ বেরোয় বেশ ভোরে। ঋষপের মোনাস্ট্রির ঠিক উল্টো দিকে …

একপেট ভাত খেয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে জানালা দিয়ে ভেসে …

আমি গ্রামের দিকে যাই সপ্তাহান্তে। সেখানে গাছপালা খুবই বেশি। তাল, …

error: Content is protected !!
Scroll to Top