বধিরতা আমাদের জীবনে এক চূড়ান্ত দুর্ভাগ্যজনক অভিশাপ। বয়সকালের বধিরতার থেকেও জন্মগত বা জন্মের ঠিক অব্যবহিত পরেই আসা বধিরতা আরও দুঃখের । এর কারণ, বয়সকালের বধিরতায় জীবনে একবার কথা বলতে শেখার পরে বধিরতা আসে বলে তাতে নিজে কথা বলতে বা অন্যের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টায় কোনো অসুবিধা হয় না । কিন্তু ‘জন্ম থেকে’ই থাকা বধিরতায় আমরা যেহেতু কানে কিছুই শুনতে পাই না, তাই কথা বলতেও শিখি না।
এটা অনেকটা ছড়া বা নামতা মুখস্ত করার মতো ব্যাপার । শিক্ষক বা অভিভাবক বাচ্চাকে পড়াতে বসে মুখে মুখে যা বলছেন, বাচ্চা কানে শুনে শুনে তাই উচ্চারণ করছে ও মানে বোঝার চেষ্টা করছে এবং সেসব শব্দ শিখে নিচ্ছে । আমাদের মস্তিস্ক হল কম্পিউটারের ‘হার্ড ডিস্ক’। যা ‘লোড’ করা হবে, তাই থেকে যাবে আমৃত্যু । পার্থক্য হল, ‘কথা শোনা’ ও তার অর্থ বুঝে নিজের মুখে উচ্চারণ করার ক্ষমতা জন্মের পর থেকে শুরু করে সারাজীবন আমাদের থাকে না । জীবনের প্রথম ৩-৪ বছরের মধ্যেই কোনো ‘স্টিমুলাস’ বা ‘উদ্দীপনা’ কানের মাধ্যমে মস্তিষ্কের শোনার ও বোঝার জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় না পৌঁছালে পরবর্তী কালে শব্দ শুনলেও তার অর্থ বোঝার ক্ষমতা চিরতরে নষ্ট হয়ে যায় । ফলে, মস্তিস্ক শব্দ হয়তো পায়, কিন্তু তার কোনো অর্থ নির্ধারণ করতে পারে না।
উদাহরণ হিসাবে সত্যিকারের ‘জাঙ্গল বুকে’র মোগলীর কথা ধরা যেতে পারে । উত্তরপ্রদেশের বুলান্দশর জেলার জঙ্গলে যখন তাকে নেকড়ে বাঘের ভিতর থেকে জোর করে ছিনিয়ে আনা হয়, তখন তার বয়স ছয় । অনাথ আশ্রমে সে শনিচর নাম পেয়ে ৩৪ বছর পর্যন্ত বেঁচে ছিল । নেকড়ে বাঘের মধ্যে থেকে সে তাদের মতোই চার হাতেপায়ে চলা বা কাঁচা মাংস খাবার বা তাদের মতোই গুটিসুটি মেরে শোবার যে স্বভাব পেয়েছিল, পরবর্তীকালে খুব ধীরে ধীরে হলেও তার কিছুটা পরিবর্তন হয়, কিন্তু নেকড়ে বাঘের মতো গর্জন করার স্বভাব যেমন তার যায় নি, তেমনি সে কোনোদিনও মানুষের কথা আর বুঝতে পারেনি । আসলে তার মস্তিস্ক এসব শেখার সময় সীমাকে পিছনে ফেলে এসেছিল । একেই ‘নিউরাল রিফ্লেক্স ‘ বলে, যা নির্দিষ্ট বয়সের পরে আর শেখা যায় না।
জিনগত বা বংশগত কারণ ছাড়াও নির্দিষ্ট সময়ের আগে জন্মানো, দীর্ঘক্ষণ প্রসবকালীন সমস্যা, মস্তিষ্কে অক্সিজেন কম সঞ্চালন, জন্ডিস, ভাইরাস সংক্রমণ, সেপসিস ইত্যাদি নানা কারণে নবজাতক জন্মপরবর্তী জীবনে সম্পূর্ণ বধির হতে পারে এবং কথা বলা শেখে না । এমন অবস্থায় যত শীঘ্র বাচ্চার চিকিৎসা শুরু করা যায় ততই ভালো । কারণ নিউরাল রিফ্লেক্স ‘ এবং তার ঐ ‘সময় সীমা ‘। ৩-৪ বছরের পরে যে কোনো ভাবে কানে শুনলেও মস্তিষ্কে তা বোঝার আশানুরূপ ‘ফল’ পাওয়ার সম্ভাবনা ক্রমাগত কমতে থাকে।
চিকিৎসার শুরুতেই কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে সমস্যার গুরুত্ব অনুধাবন করে কানে শোনার মেশিন ব্যবহার করা হয় বাচ্চার মস্তিষ্কে যে কোনো ভাবে ‘শব্দ’ পৌঁছানোর জন্য । কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই বধিরতা মেশিনের কার্যক্ষমতার বাইরে চলে যায় । তখন উপায়?
উপায় আছে। ‘ককলিয়ার ইমপ্লান্ট‘ (Cochlear Implant)।
সেটা কী?
হৃদপিন্ডের ছন্দ বা ‘গতি’ যদি ক্রমাগত কমতে থাকে, তাকে আমরা বলি হার্ট ব্লক । এ ব্লক রক্ত সঞ্চালনের ‘ব্লক’ নয়। যে ‘ইলেকট্রিক ইমপালস’ বা ‘কারেন্ট’ হৃদপিন্ডকে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য নির্দিষ্ট গতিতে ‘পাম্প’ করতে নির্দেশ পাঠায়, তার কর্মক্ষমতা কমে গেলে হৃৎপিন্ডের গতি কমতে থাকে এবং শরীরে / মস্তিষ্কে রক্তসঞ্চালন/ অক্সিজেন প্রবাহ কমে গিয়ে আমরা অজ্ঞান হয়ে যেতে পারি, এমনকি আমাদের মৃত্যু পর্যন্ত হয় । এর জন্য আমাদের শরীরে ‘পেস মেকার’ বসানো হয় । হৃদপিন্ড তার নির্দিষ্ট গতি ফিরে পায় । আমরা কাঙ্খিত জীবনে ফিরে আসি।
ঠিক এমন করেই কানের সম্পূর্ণ বধিরতায়ও এখন আমরা ‘পেস মেকার’ ব্যবহার করি । একেই ‘ককলিয়ার ইমপ্লান্ট ‘ বলে । এর যথার্থ ব্যবহারে জন্ম থেকে বধিরতায় ভোগা বাচ্চা অন্য বাচ্চার মতোই কানে শুনে কথা বলা শেখে ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।
আজ একথা লেখার উদ্দেশ্য দুটি-
প্রথমত, অবশ্যই সাধারণ মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি, যাতে ‘বোবা-কালা’ অভিশাপ কারো জীবনে না থাকে।
দ্বিতীয়ত, আজ রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানে এর উপরে যে ওয়ার্কশপ চলছে, এবং এ কাজ যে ক্রমাগত কলকাতা শহরে সাফল্যের সঙ্গে হয়ে চলেছে, সে সম্বন্ধেও এ শহরের মানুষের মনে সেই একই সচেতনতা নিয়ে আসা।
সবশেষে বলি, এমন বহু অসুখ আছে যাদেরকে কেবলমাত্র সচেতনতা দ্বারাই প্রতিহত করা অথবা সাফল্যের সাথে চিকিৎসা করা সম্ভব । কানে শোনার সমস্যা এমনই একটি । সবাই এ সম্পর্কে সচেতন হোন এবং পাশের মানুষকেও সচেতন করুন।