ঘাটতি

আমি গ্রামের দিকে যাই সপ্তাহান্তে। সেখানে গাছপালা খুবই বেশি। তাল, সুপারি আর নারকেল বাদ দিলে বাকি সব গাছে ডালপালাও মেলা। এখানকার দুচারটে পড়াশোনা করা মানুষ ছাড়া বাকিদেরও তাই বয়সের অগুন্তি ডালপালা । এত গাছগাছালি যখন তখন তাদের সাথে মানুষের গা ঘষাঘষির আন্তরিকতাও বেশি হওয়ারই কথা।একইসাথে এখানে যাহা বাহান্ন তাহাই বাহাত্তর – সবই এক।কানের রোগী। বয়স বাহান্ন । এটা কাগজে লিখেও মনটা খচখচ করছিল। আসলে সামনের ‘বৃদ্ধা’কে একটু আগে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,-বয়স কত?উনি বললেন,-আন্দাজ করে একটা দিয়ে দাও।আমি মুখ আর চেহারার দিকে আরও একবার চেয়ে বললাম,-বাহাত্তর দিই?উনি বললেন,-এত দেবে? বড্ড বেশি হচ্ছে । এট্টু কমায়ে দাও। বাহান্ন করো বাবা।গ্রামের মানুষের বয়স সময়ের কড়াইতে নিজের ইচ্ছেয় ওলোটপালোট খায়। যাহা বাহান্ন তাহাই বাহাত্তর। এখানে সবই তেলের পিঠে। ঠিকঠাক একটু উল্টেপাল্টে নিতে পারলেই সুস্বাদু । মানে মেজাজ বাহান্ন হলেও বয়স হয়তো বাহাত্তর অথবা বয়স বাহান্ন হলেও মেজাজটা উল্টো।যা হোক, বাহাত্তরের বুড়িমা বাহান্নর মেজাজে আমার সামনে কানের সমস্যা নিয়ে বসে এক বিচিত্র ফিরিস্তি দিয়ে বসলেন আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই। সেটাই এখানে বলার উদ্দেশ্য এবং বলি।উনি শুরু করলেন,-আমার সব কথা শুনতি হবে কিন্তু। অনেক চিকিৎসে করেছি কান নিয়ে কিন্তু কিছুতেই তো কেউ কিছু করতি পারল না। আমার কথা শেষ হলি তুমি আমারে বলবা কেন এমন হল। সারল না কেন আমার কান। ছাতি আর ব্যথার অসুখ ছাড়া শীতের দিনে ডাক্তারদের সামনে রোগীর চাপ হালকা হয়। রোগী লেপের গর্ত ছেড়ে ডাক্তারের ফাঁদে ফাঁসে না। শীতেই তাই চিকিৎসা সম্মেলনগুলো হয় এ দেশে। সময় থাকে বলে শীতে রোগীর সাথে গল্পও জমে বেশি।আমি পেনের ঢাকনা বন্ধ করে বললাম ,-অনেক বছর তো পড়াশোনা আর চিকিৎসা করলাম। বল তোমার কথা। চিকিৎসা গলদ কোথায় শুনে বলছি।উনি বললেন,-তাইতো খবর পেয়ে এলাম। কান চুলকানি আমার। অসহ্য চুলকানি। হাতের কাছে যা পাই তাই দিয়ে চুলকাই। কাপড়ের আঁচল পাকায়ে দিই। ‘সেফটিন’ পুরি কানে। কাগজ, পানের বোঁটা, ঝাঁটার কাঠি- সব। চুলকে চুলকেও চুলকানি কমে না। শেষে গেরামের অনেক ডাকতার দেখালাম। একজন বললো , ডাবের পানি কানের ভিতর পুরে কাত হয়ি শুয়ে থাকতি। টানা একদিন। তা আমি তিনদিন শোলাম। কিছুই হল না। একজন বলল কাঁচা হলুদ আর পানের পাতা একসাথে থেঁতো করে তার রস ওর খোলে পুরতি। সে দিয়েও কিছু হল না। রসুন তেল গরম করি দেলাম। থানকুনি আর কালমেঘ পাতা বেটে পুরিয়া মতো বানায়ে একজন পুরে দিল দুই কানের ফুটোয়। তিন দিন রাখলাম। সে সব্বনেশে চুলকানি কমলো তো নাই উল্টে আরও বেড়ি গেল। কানে দু দুটো মাদুলি লাগলাম। সুতো সমেত মাদুলি ছিঁড়ে পড়ে গেলি নাকি ওর সাথে চুলকুনিও বিদেয় নেবে। ঘোড়ার ডিম হল। একজন কান ঝাড়ায়ে বলল চন্দন লাগাতি। তা কমলাদি নিজে চন্দন বেটি কানের খোলে ফোঁটা দিল সাত দিন। শেষে আর না পেরি তোমার কথা শুনে এখেনে এলাম। শোনলাম তুমি বড় ডাক্তার। তোমারে বলতি হবে, আমি এত কষ্ট করলাম, পয়সা খরচা করি ছুটে মরলাম, আমার চুলকুনি কমলো না কেন এতে? বলতি পারলি বোঝবো তুমি চাঁদ পড়াশোনা ঠিকমতো করেছো। আমার পয়সা আর এভাবে নষ্ট কোরো না বাপ্। চাঁদ আকাশে থাকে। ভাগ্যবান শুনেছি হাতে চাঁদ পায়। কেউ আমাকে চাঁদ বলে কখনো ডাকেনি আগে। কিন্তু এখন সে ডাক শুনেও হতভম্ব আমি মুখখানা অমাবস্যার চাঁদের মতো করে আমার রোগীর দিকে চেয়ে রইলাম। আমার পড়াশোনার বড় ঘাটতিটা বাহান্ন মনের বাহাত্তরের রোগী এক পলকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল আর আমি চুপচাপ গালে হাত দিয়ে বসে থাকলাম।বিশুটাও আজকাল ফচকে হয়ে যাচ্ছে। দেখলাম সে হতচ্ছাড়া ওর স্যারের অবস্থা দেখে মুখ টিপে টিপে হাসছে। drsajalsur March 7, 2024 No Comments Nextহারানো ভালোবাসাNext

ঘাটতি Read More »